অনুবাদ করুন ।

মঙ্গলবার, ২৮ মে, ২০১৩

নামাজ .




সেদিন ছিল বৃহষ্পতিবার।চট্টগ্রাম নিউ মার্কেট দুপুর তিনটা বাজে বন্ধ হয়ে যায়। সকালে বাসা থেকে তৈরী হয়ে এসেছিলাম তাই দোকান বন্ধ করে সোজা বহদ্দার হাট বাস ষ্টেশনে চলে এলাম। কক্সবাজারগামী বাসে উঠলাম যদিও আমি যাব দোহাজারী।
যাওয়ার কারণটা আগে বলি আমাদের ক্রয় করা একটা জায়গার ব্যাপারে সালিশ ছিল। সালিশটা হবে চন্দনাইশ উপজেলার ধোপাছড়ি ইউনয়নে। কারন যাদের থেকে জায়গাটা কিনেছি তাদের কিছু ওয়ারীশ ওখানে থাকে। তাই ওখানে শুক্রুবার গ্রাম্য সালিশ হবে সেই সালিশে ওদের থেকে ওয়ারীশ হিসেবে জায়গার দলিলে কয়েকটা স্বাক্ষর নিতে হবে।
ধোপাছড়ি ইউয়নিয়ন চন্দনাইশ উপজেলায় হলে কি হবে জায়গাটা দূর্গম এলাকা। যাতায়াত ব্যাবস্থা যাছ্ছে তাই অবস্থা। চট্টগ্রাম থেকে বাসে যেতে হবে দোহাজারী তারপর দোহাজারী থেকে রিক্সায় যেতে হবে টেক্সি স্টান্ডে। সেখান থেকে বেবি টেক্সিতে প্রায় আধা ঘন্টা যাত্রা করে যেতে হবে শংখ নদীর ঘাট, সেখান থেকে বোটে প্রায় দুই ঘন্টা চড়ে যেতে হবে ধোপাছড়ী। চট্টগ্রাম থেকে কক্সবাজার যেতে লাগে প্রায় তিন ঘন্টা। কক্সবাজারের চার ভাগের এক ভাগ রাস্তা ধোপাছড়ী যেতে লাগে প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা। তবে যাত্রার কষ্টটুকু মেনে নিয়ে কেউ যদি দিনের বেলা ধোপাছড়ী যায় তাহলে দেখতে পাবে প্রকৃতির অপরুপ রুপ। যা শুধু দেখা যায় উপভোগ করা যায় কিন্তু বোঝানো বা লেখনির ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। এতই সুন্দর সেই রুপসী প্রকৃতির অপরুপ রূপ। শান্ত শংখ নদীর দুই পাশে গাছগাছালী আর পাখপাখালী ভরা সবুজ পাহাড় নদীর দুই পাড়ের ঢেউয়র সাথে করছে কত গোপন কানাকানি। তাদের এই ভাবের কথার ছলাৎ ছলাৎ শব্দ বোঝে কার সাধ্য। শুধু শুনেই কান জুড়িয়ে যায়, বুজতে পারলে হয়ত পাগল হয়ে যাবে মানুষ। গোধুলী বেলার আকাশ শংখ নদীর টলটলে সছ্ছ পানিতে নিজের চেহারা দেখে, মেঘে লাল রং মেখে নিজেকে সাজিয়ে নিছ্ছে রাতের তারাদের বরন করার জন্য। মনে পড়ে যায় সেই গানটি হায়রে আমার মন মাতানো দেশ .....।
প্রায় ঘন্টা দেড়েক পড়ে দোহাজারী নামলাম। আছরের নামাযের সময় হয়ে গেছে অনেক আগে, তাই বাস থেকে নেমেই অজু করে নামাজ পড়ে নিলাম। তারপর একটা রিক্সা ভাড়া করে টেক্সি স্টান্ডে গেলাম। তখন প্রায় গোধুলী লগন। যাই হোক টেক্সি চলতে লাগল। গোধুলী বেলায় গ্রামের রাখাল, গরূ, ছাগল, হাস, মুরগীর ঘরে ফেরার দৃশ্য দেখতে দেখতে শংখ নদীর ঘাটে এসে যখন পৌছলাম তখন মাগরীবের আযান দিছ্ছে।

শংখনদীর ঘাটটা খুবই সাধারণ একটা ঘাট। টেক্সি ষ্ট্যান্ড আছে।বেড়ার তৈরী একটি ভাংগা চোরা একটা হোটেল। হোটেলের মেঝেটা যেন পার্বত্য এলাকার ম্যাপ। ভীষন রকমের উচুনিচু । নড়বড়ে কয়েকটা চেয়ার-টেবিল আছে। আছে কিছু গ্রাহক। যারা সবাই বলতে গেলে খেটে খাওয়া নিম্ন আয়ের গ্রাম্য লোক। টেক্সি ড্রাইভাররা এখানে বসে না। ওরা দোহাজারীতে নাস্তা করে।
মাগরীবের নামাজের সময় ফাগুনের প্রথম দিকে খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। তাই এই মসজিদ বিহীন জায়গায় কিভাবে নামাজ পড়া যায় এ নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। সেই সাথে পড়ে গেলাম আরেক বিপদে। শীত কালে নদীতে পানি কমে যায়। নদীর নাব্যতার অভাবে নদীর কিছু কিছু জায়গায় ডুবো চর জেগে উঠে। এতে রাতের অন্ধকারে বোট চালানো অসম্ভব হয়ে যায়। তাই মাগরীবের সময়ই শেষ বোটটা ধোপাছড়ীর উদ্দেশে চলে যায়। আমি ঘাটে যেয়ে অপেক্ষারত যাত্রীদের জিগ্গাসা করলামঃ শেষ বোটটা আসতে কতক্ষন লাগবে ?
ওরা ঘাটে দাড়িয়ে নদীর যতটুকু দেখা যায় ততটুকু দেখে বললঃ আরও বেশ কিছুক্ষন দেরী হবে।
আমি বললামঃ ভাই আমি মাগরীবের নামাজ পড়তে যাছ্ছি। এরমধ্যে যদি বোট আসে একটু অপেক্ষা করতে বলবেন।
লোকটি মাথা কাত করে বললঃ ঠিক আছে।
আমি এবার দ্রুত এসে নামাজের জায়গা খুজতে লাগলাম। ঘাটের চারপাশে চোখ বুলিয়ে নামাজ পড়ার সুবিধাজনক কোন স্থান না পেয়ে হোটেলে ঢুকলাম। ক্যাশে বসা লোকটিকে বললাম ঃ ভাই এখানে নামাজ পড়ার কোন জায়গা নাই?
লোকটা মাথা নেড়ে বললঃ না। এখানে নামাজের কোন বন্দোবস্ত নাই।
ঃএকটা জায়নামাজ হবে ? তাহলে আমি এখানে কোথাও নামাজটা পড়ে নেব। লোকটা কিছুক্ষন চিন্তা করে একটা ছেলেকে ডাক দিয়ে বললঃ তাড়াতাড়ি অমুকের বাসায় যা। যেয়ে বলবি একজন নামাজ পড়বে জায়নাজটা দিতে বলেছি। ছেলেটা দৌড়ে চলে গেল। মোটামুটি তাড়াতাড়ি একটা জায়নামাজ নিয়ে এল। আমি ছেলেটার হাত থেকে জায়নামাজটা প্রায় ছিনিয়ে নিলাম। এর মধ্যেই নামাজের জায়গা ঠিক করে ফেলেছি ।কেননা হোটেলের মেঝের যে অবস্থা ওখানে জায়নাজ বিছিয়ে নামাজ পড়া অসম্ভব। হোটেলের একপাশে মাচা বাধা ছিল। হয়ত রাতে কর্মচারীরা ওখানে ঘুমায়। আমি ওখানে উঠে বসে বসে নামাজ পড়লাম কারন দাড়িয়ে পড়তে গেলে মাথা দোকানের চালের সাথে লাগবে। শুধু ফরজটুকু পড়লাম। তারপর জায়নামাজটা ক্যাশে বসা লোকটার হাতে দিয়ে দ্রুত ঘাটে এলাম । ঘাটে এসে দেখি ফাকা ঘাট। অপেক্ষারত যাত্রী বোট কিছুই নাই। আমি হতভম্ব সেই সাথে হতাশ। এখন হয়ত আবার দোহাজারী তারপর চট্টগ্রাম ফেরৎ যেতে হবে। মনের ভেতর শয়তান কুমন্ত্রনা দিতে লাগল নামাজ পড়ার কি দরকারটা ছিল? পরে কাজা পড়া যেত না। কিন্তু শয়তানের কুমন্ত্রনা সত্বেও মনের ভেতর কে যেন বলছেঃ ধৈর্য ধর এবং চেষ্টা কর।
আমি জানি চলে যাওয়া বোটটা আজকের শেষ বোট তারপরও না জানি কিসের আশায় ঘাটে দাড়িয়ে রইলাম জানি না। হঠাৎ মনে পড়ল এখন থেকে বোট রিজার্ভ করে যাওয়া যায়। নদীর পাড়ে কয়েকটা বোট দাড়িয়ে আছে আমি এক বোট ওলার সাথে আলাপ করলাম। সে বলল আড়াইশ ( দুইশত পন্চাশ) টাকা লাগবে। বোটের ভাড়া শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। কোথায় বোটের যাত্রী প্রতি ভাড়া ১২টাকা কোথায় ২৫০টাকা ! আবার শয়তান কুমন্ত্রনা দিতে লাগল। আমি পাত্তা না দিয়ে দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভাবতে লাগলাম। আজকে যে ভাবেই হোক যেতে হবে। কিন্তু কিভাবে?
আমার এভাবে বোটের ওখানে যাওয়া দরদাম করে ফিরে আসা আবার হতাশ ভাব নিয়ে দাড়িয়ে থাকা এসব কান্ড ঘাটে বসা হালকা পাতলা গড়নের একটি ছেলে লক্ষ্য করল। সে বুঝতে পারল আমি শহর থেকে এসেছি। ধীরে ধীরে ছেলেটি আমার নিকটে এল। সালাম দিল । জবাব দিলাম ।
ঃ ভাইয়া আপনিকি কোন সমস্যায় পড়েছেন?
আমি বিরক্ত ভাব নিয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে বললামঃ হ্যা। ধোপাছড়ী যাওয়ার শেষ বোটটা ধরতে পারিনি।
ঃতাহলে রিজার্ভ বোট নিয়ে চলে যান।
্‌যে ভাড়া চাছ্ছে কি করে যাব?
ঃ কত চায়?
ঃ ২৫০ টাকা।
ছেলেটা কিছুক্ষন চুপ করে রইলঃ ওখানে কার কাছে যাবেন।
ছেলেটির এই প্রশ্নে আমার মাথা গরম হয়ে গেল। কি জ্বালারে একেতো শেষ বোটটা হারিয়েছি তার উপর এ কোন ফ্যাসাদ জুটল। এখন কথা বলতে ইছ্ছে করছে না আর এই ব্যাটা একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাছ্ছে। বিরক্ত লাগলেও ভদ্রতার খাতিরে কিছু না বলে উত্তর দিতে লাগলাম।
আমার আত্তিয়র পরিচয় দিলাম। চিনতে পারল কিনা বুজতে পারলাম না।এবার ছেলেটি বললঃ আপনি একটা কাজ করেন ঐ যে ওখানে চারজন লোক বসে আছে ওখানে দুইজন বনবিভাগের লোক।
আমি ছেলেটির নির্দেশিত দিকে তাকালাম দেখতে পেলাম অদুরে চারজন লোক দুইটা বেশ বড় বড় গাছের গুড়ির উপর বসে কথা বলছে। দুইজন লুংগী পরা একজন খাকি রং এর পোষাক পরা বোঝাই যাছ্ছে লোকটি সরকারি বাহিনীর লোক। অর্থাৎ সে ফরেষ্ট গার্ড। চতুর্থ জনের পোষাক সিভিল হলেও কিছুটা পরিপাটি বুজতে পারলাম ইনি বন বিভাগের অফিসার।

ছেলেটি বললঃ এনারা ধোপাছড়ী বনবিভাগের লোক। ওনারা ঐ বোটটা (নদীর ঘাটে বাধা চারটা বোটের মধ্যে কোনটা দেখাল বুজতে পারলাম না।) নিয়ে ধোপাছড়ী যাবে। আপনি অফিসারকে অনুরোধ করে দেখুন। হয়ত আপনাকে নিতে পারে।
আমি ছেলেটির কথায় আশান্বিত হলাম। ছেলেটিকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি অফিসারের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাকে ওনার দিকে আসাতে দেখে অফিসার আমার দিকে জিগ্গাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
ঃ আমি আপনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।
ঃবলুন।
ঃ আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি ধোপাছড়ী যাওয়ার উদ্দেশে। কিন্তু এখানে এসে মাগরীবের নামাযের সময় হয়ে গেছে বিধায় নামাজ পড়তে যেয়ে আজকের শেষ বোটটা ধরতে পারি নাই। একজনের কাছ থেকে জানলাম আপনারা ধোপাছড়ী যাবেন। তাই অনুরোধ করছি আপনাদের সাথে যদি আমাকে নিয়ে যান তাহলে আমি উপকৃত হব। তানা হলে আমাকে চট্টগ্রাম ফিরে যেতে হবে।
অফিসার আমার বক্তব্য শুনে বললেনঃ আপনি ওখানে কার কাছে যাবেন ?
আমি আমার আত্তিয়র পরিচয় দিলাম ( আত্তিয়টি ওখানকার সারের ডিলার ও বাংলাদেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে একটির বড় গোছের নেতা ।) তাই পরিচয় দেওয়ার সাথে সাথে চিনতে পারলেন। তিনি বললেন অসুবিধা নাই। একটু অপেক্ষা করুন এখানকার কাজগুলো সেরে আমরা রওয়ানা দেব। দশ পনের মিনিট পরই আমরা রওয়ানা দিলাম ।
সন্ধ্যার মায়াবী আধারে শংখ নদীর বুক চিড়ে চলছে বনবিভাগের বোট। আমরা তিন জন বোটের ছাদে মাদুর বিছিয়ে বসে আছি। ফাগুনের ঝিরঝিরে বাতাসে শরীর মন দুই জুড়িয়ে যাছ্ছে। আল্লাহ রহমানুর রহিমের করুনার কথা ভেবে, আমার দুই চোখ নোনা জলে টলমল করছে। এই বুঝি নোনা জল কপোল বেয়ে আছড়ে পড়ে শংখ নদীর বুকে। নিজেকে বার বার তিরষ্কার করছি। শেষ বোট না পেয়ে কত কিছুই না ভাবেছি। ঐ বোটে গেলে কত কষ্ট করে যেতে হত। ছাদের নিচে গুমটি ঘরের মত চিপা জায়গার মধ্যে অনেক লোকের সাথে গাদাগাদি করে বসতে হত। সেখানে ইন্জিনের ধোয়া আর ভটভটি বিকট আওয়াজে কান আর মাথার দফারফা হয়ে যায়। সেই সাথে বোট ভাড়াত আছেই। আর এখন, কত আরামে ফাগুনে হাওয়ায় গা জুড়িয়ে নদীর ঢেউয়ের দোল খেতে চলছি। আকাশে সূর্যের রক্তিম আভা এখনও লেগে আছে। নদীর পাড়ের গ্রামের বউ-ঝিরা কলসী ভরে রাতের পানি নিছ্ছে। খেতের কাজ শেষে চাষী-কামলা হাত-মুখ ধুয়ে নিছ্ছে। বিশাল ঝাক বেধে চেনা-অচেনা পাখিরা নদীর পাড়ের গাছগাছালির আড়ালে রাতের রাতের সুখ খুজে নিছ্ছে। আর আমি আমার আল্লাহর বার বার ক্ষমা চাছ্ছি আর শুকরিয়া আদায় করছি। হূদয়ের অন্তস্থল থেকে বার উচ্চারিত হছ্ছে আল্লাহ তুমি কত দয়াময়।
আরেকটি কথা না লিখলেই নয়। আমরা ধোপাছড়ী পৌছেছিলাম লোকাল বোটটির প্রায় বিশ মিনিট আগে।
(ঘটনাটি প্রায় আট বছর আগের)

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন