অনুবাদ করুন ।

রবিবার, ১০ সেপ্টেম্বর, ২০১৭

সম্পত্তি

উহ !! কি বৃস্টি ! যেন আকাশ নামক কলসিটার কোথাও বিশাল ফুটো হয়ে গেছে, যেন তার ভেতরকার সব পানি গড়িয়ে জমিনে পড়ছে । পিচঢালা রাস্তা, কিছুদুর পর পর সিটি কর্পোরেশনের লাইট জ্বলছে তাই আছড়ে পড়ার সমস্যা নাই, যতটা সম্ভব দ্রুত হাটার চেস্টা করছি । মোবাইলে সময় দেখলাম রাত একটা চল্লিশ বাজে ।স্লেট রংগা আকাশে হঠাত হঠাত বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। মনে পড়ছে ঠিক এমন পরিস্থিতিতে আরেকবার পড়েছিলাম আজ হতে তিরিশ বছর আগে ।
পূর্বের ঘটনাটা আগে বলি।
তখন আমার বয়স প্রায় পনের কি ষোল বৎসর । আমাদের দুই ভাইকে এতিম করে বাবা মারা গিয়েছেন প্রায় আট মাস আগে । আমার মা গ্রাম্য বিধবা মহিলা । পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী আমার পিতা মারা যাওয়ার পর অভাবে পড়ে গেলেন । আত্মীয় স্বজনের দান-দক্ষিনায় মাস দুইয়েক চলার পর শুরু হল ধার কর্জ । প্রথম প্রথম ধার পাওয়া গেলেও মাসখানেক এর মধ্যও যখন ধারের টাকা ফেরত দিতে পারলেন না , তখন তাও বন্ধ হয়ে গেল । এখন আর কোন উপায় না দেখে আত্মিয়দের পরামর্শে আমাকে ক্লাস টেন থেকে ছাড়িয়ে, শহরে পাঠিয়ে দিলেন চাকরি করার জন্য ।
আব্বা মারা যাওয়ার পর আরেকটা সমস্যা দেখা দিল । আমাদের সম্পত্তির শরিকদাররা যে যেভাবে পারছিল আমাদের অভিভাবকহীন সম্পত্তি গ্রাস করা শুরু করল । গ্রাস করার কারন হল, আমার দাদার কেনা কিছু সম্পত্তি ছিল যা উনি উনার আপন ভাই হতে ক্রয় করে ছিলেন। তখন ব্রিটিশ আমল তাই হয়ত রেজিস্ট্রি করা হয় নাই । যথা সম্ভব মৌখিক ভাবেই বেচা কেনা হয়েছিল। তাই কোন কাগজ পত্র হয়েছিল কিনা তখন আমাদের জানা ছিল না । আমার বাবাও জানতেন কিনা জানিনা । যাই হোক, সেই দাদার ওয়ারিশরা এখন বলছে, এই সম্পত্তি ওদের দাদা আমার দাদার কাছে বিক্রি করেন নাই । আমার দাদা অভাবি ছিল, তাই ব্যাবহার করতে দিয়েছিলেন ।যদিও এতদিন জেনে এসেছি আমার দাদার সাহায্য ওর দাদার প্রায় প্রয়োজন হত ।
এই নিয়ে আগামিকাল গ্রাম্য সালিশি হবে সেখানে আমরা যদি কোন প্রমান দেখাতে পারি যে, আমার দাদা এই জায়গা ক্রয় করেছিলেন, তাহলে আমাদের জায়গা আমাদেরই থাকবে তানা হলে ওরা জায়গা দখল করে ফেলবে।
আমি আজ সন্ধ্যায় আমাদের গ্রামের এক লোক মারফত আগামীকালের সালিশির খবরটা পেয়েছি । আমার বিধবা মা জায়গা বাঁচানোর আর কোন পথ না পেয়ে আমার কাছে খবর পাঠিয়েছেন, যেভাবেই হোক কাল যেন সালিশীতে হাজির থাকি । আমি জানি কিছুই করতে পারব না, তারপরও অসহায় মা আমার কি করে এই সালিশিতে হাজির হবেন।এই ভেবে আমি যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার মা ছিলেন খুবই দ্বীনদার পর্দানশীন মহিলা।
যাইহো্‌ক, খবর পেয়ে রাত নয়টা বাজে মালিক হতে ছুটি নিয়ে বাস ষ্টেশন আসতে আসতে দশটা বেজে গেল । স্টেশনে এসে দেখি কোন গাড়ি নাই । অনেকক্ষণ অপেক্ষার আমার মত আরও বেশ কিছু যাত্রী পাওয়া গেল । তবে তারা সবাই কাছের যাত্রী । আমার মত দুরের কেউ নাই । কাছের যাত্রিদের নেওয়ার জন্য একটা গাড়ি পাওয়া গেল । কি আর করা যতটুকু এগিয়ে থাকা যায় এই ভেবে আমিও ওই গাড়িতে উঠে পড়লাম।গাড়ি ছাড়ার কিছুক্ষন পর শুরু হল মুষলধারে বৃস্টি । আমি ঘাবড়ে গেলাম হায় একি অবস্থা মড়ার উপর দেখি খাড়ার ঘা। বের হওয়ার সময় রাতের আকাশ খেয়াল করিনি তাই ছাতিটাও নেওয়া হয় নাই । নিরুপায়, এখন কিছুই করার নাই তাই দেখা যাক কি হয় এই ভেবে নিজেকে দুশ্চিন্তা মুক্ত করলাম । আমার বাড়ি হতে দশ মাইল দূরে থাকতেই বাস তার যাত্রা শেষ করল । তখন বাজে রাতের বারটা । বৃষ্টি অনেকটা কমে এসেছে । বাসের সব যাত্রী নেমে যার যার গন্তব্য চলে গেল । আমি একা ছোট নির্জন দোকানপাট বন্ধ এক বাজারে দাঁড়িয়ে আছি । এখান হতে আমাদের বাড়ি আরও দুই মাইলের মত । কি করব ভাবছি , এমন সময় দেখি একটা বেবি ট্যাক্সি এসে দাড়াল । ড্রাইভারের পাশের সিটটা খালি । আমি তাড়াতাড়ি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করলাম কোথায় যাবে ? ড্রাইভার জায়গার নাম বলতেই বুজতে পারলাম । এই গাড়িতে এক মাইলের মত যেতে পারব তারপরের পথটুকু আমার হেটে যাওয়া ছাড়া আর কোন গতি নাই । যথাস্থানে বেবিট্যাক্সি থেকে নামলাম ।নেমে বাড়ির উদ্দেশে হাঁটা শুরু করলাম ।
মধ্য রাতের সময় পার হয়ে ঘড়ির কাটা প্রায় একটার ঘর ছুই ছুঁই ।ঘুট ঘুটে অন্ধকার কিছুই দেখা যাচ্ছে না । চাঁদ বিহীন আধার রাতেরও একটু আলো থাকে । দূর আকাশের তারার আলো ।, কিন্তু মেঘে ঢাকা আকাশ মনে হয় কবরসম অন্ধকার ।নিজের বাড়ির চেনা পথ তাই হাটতে তেমন সমস্যা হচ্ছে না । ঝিরি ঝিরি বৃষ্টিতে গ্রামের মেঠো পথটা পিচ্ছিল হয়ে আছে । সাথে কোন ছাতা নাই তাই ইতিমধ্য প্রায় কাক ভেজা হয়ে গেছি ।
হাটছিত হাটছি পথ যেন আর ফুরায় না । এখনও মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে সেই সাথে কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস গায়ের কাপড় ভিজে কাঁপুনি ধরে গেছে , ক্ষনে ক্ষনে আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে । বিদ্যুতের আলোয় দেখছি এখনও আরও আধা ঘন্টার রাস্তা বাকি।বাবার রেডিয়ামওলা হাত ঘড়িটা দেখলাম রাত একটা বিশ মিনিট। আঁধারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না । হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে উচু হয়ে থাকা ছোট্ট ঢিবিতে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলাম। ঠিক এই সময় কে যেন আমার হাত ধরে টান দিল।চমকে উঠলাম! লোকটির টানে আমি উঠে দাড়ালাম। আঁধারে কিছু দেখতে পাচ্ছিনা। এই সময় আবার বিদ্যুৎ চমকে উঠল । দেখতে পেলাম এক বৃদ্ধ লোক । মুখে সফেদ দাড়ি। আমার হঠাত ভয় পেয়ে উঠা বুকটা নির্ভরতায় ভরে গেল। আমার দিকে আন্তরিকতার সাথে মুচকি হেসে তাকিয়ে রয়েছেন । উনাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগল । কোথায় দেখেছি মনে করতে পারছি না । স্পষ্ট বুঝতে পারছি উনি আমার খুবই চেনাজানা কিন্তু অনেক চেস্টা করেও উনার পরিচয় মনে করতে পারলাম না । বৃদ্ধ লোকটি বলল “বাড়ি বোধহয় আর বেশি দূরে নাই চল ওই শশ্মানের পথটুকু পাড় করে দেই ।
এতক্ষন শশ্মানের ব্যাপারটা একটুও মনে ছিল না । উনি বলাতে সারা দেহ ভয়ে কেপে উঠল । বৃদ্ধ বোধহয় বুজতে পারলেন। “ ভয় নাই আমি সাথে আছি। তোকে জায়গাটা পার করে দিয়ে যাব।“
আমার ভয় অনেকটা কেটে গেল । শশ্মানটার ভালই বদনাম আছে। অনেকেই এখানে অনেক কিছু দেখে ভয় পেয়েছে । তাই রাতের বেলা কেউ একা শশ্মানটার পাশ দিয়ে যেতে চায় না । তারপরও কেউ যদি একা যায় তাহলে সে ভীতিকর কিছুনা কিছু দেখবেই । এতে অনেকেরই পরবর্তী জীবনে দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
দুজনে নীরবে পাশাপাশি হেটে আমাদের পাড়ার মুখে চলে এলাম। বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে গেলেন।আমার হাতে পলিথিনে জড়ানো কিছু কাগজ দিয়ে বললেন “ আগামী কাল অমুক মাতব্বরকে এই কাগজগুলো দিবি। “
আমার হাতে দেওয়া কাগজগুলো দেখার জন্য মাথা নিচু করে আবার তাকাতেই দেখি আশেপাশে কেউ নাই । পাড়ার রাস্তার মুখে এই অন্ধকারে আমি একা বৃস্টিতে ভিজছি । বৃস্টি ভেজা ঠাণ্ডা বাতাসে না ভয়ে কেন জানিনা , আমার শরীর কাঁপতে লাগল । তাড়াতাড়ি বাসায় এলাম। মাকে সব ঘটনা বললাম । মা শুনে তাড়াতাড়ি সুরা ফালাক সুরা নাস পড়ে আমার গায়ে ফু দিতে লাগলেন । কিছুক্ষন পর আমি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ার পর মা পলিথিনের ভিতর থেকে কাগজগুলি বের করে দেখতে দেখতে উনার দুই চোখ খুশীতে ঝলমলিয়ে উঠল আর মুখে অনবরত” সোবহানাল্লাহ ! সোবহানাল্লাহ !” পড়তে পড়তে বললেন “এগুলি তোর দাদার কেনা জায়গার রেজিস্ট্রির দলীল।‘”
তখনই আমি বৃদ্ধ লোকটিকে চিনতে পারলাম। লোকটি ছিল আমার দাদা যিনি আমার দশ বছর বয়সে মারা গিয়েছেন ।
সেই হতে তিরিশ বছর পর, আজ আবার একই আবহাওয়ায় পড়ে রাতের আঁধারে ভিজে ভিজে বাড়ি যাচ্ছি । কি অদ্ভুত মিল সেই তিরিশ বছর আগের রাতটির সাথে আজকের রাতের। যদিও এই তিরিশ বছরে আমার জীবন অনেক খানিই বদলে গেছে। বয়স বেড়েছে বদলেছে সামাজিক অবস্থান । সেদিন আমি ছিলাম দোকানের সাধারন কর্মচারী আজ আল্লাহর রহমতে আমি চারটি দোকানের মালিক । শহরে নিজের চারতলা বাড়ি। নিজস্ব প্রাইভেট কারে চলেফেরা করি।
আজও বাড়ি যাচ্ছি দাদার সেই জায়গার ব্যাপারে। ওয়ারিশ সুত্রে এখন সেই জায়গার মালিক আমরা দুই ভাই। আমার ছোট ভাই বছর খানেক আগে মারা গেছে। এরপর থেকে ওর সংসারের সম্পূর্ণ ব্যায়ভার আমিই বহন করছি । ভাইটির একমাত্র ছেলে সন্তানের পড়লেখা এবং মা ও ছেলে জিবনযাত্রার যাবতীয় দায়িত্ব আমিই বহন করছি । তারাই নাকি গতকাল আমার দাদার কেনা সেই জায়গা ভাগ করার কথা বলেছে। ভাগ করে দিলে ওরা ওই জায়গায় কিছু গাছ পালা রোপণ করবে। এখন আমার অনুমতি না পেলে ওখানে কিছু করতে পারছে না। আমি ওদের এই কথা শোনার পর মাথার মেজাজ গরম হয়ে গেছে। কারন ওই জায়গাটা সম্পূর্ণ আমার নামে নামজারি করে, সেখানে বাংলো টাইপের একটা বাড়ির করা ইচ্ছা আছে । তাই ওরা ওদের ভাগ খোঁজা কারনে আমার সেই স্বপ্ন ভেঙ্গে যাওয়ার উপক্রম । তাই খবর পাওয়ার সাথে সাথে বাড়ি আসার জন্য চিন্তা করলাম, কিন্তু দোকানের হিসাব কিতাব সারতে সারতে রাত বারটা বেজে যাওয়ায় বের হতে দেরি হয়ে গেল। দেরি হলেও তেমন কোন সমস্যা ছিল না , কারন নিজের প্রাইভেট কারে করে যাব তাই চিন্তা নাই । যথাসময়ে গাড়ি নিয়ে বের হলাম , ভালই চলছিল বাড়ির পথ প্রায় মাইলখানেক থাকতেই হঠাত গাড়িটা নষ্ট হয়ে গেল । বাইরে বৃস্টি ছাতিটাও আনা হয়নি । তাই কি আর করা এই বৃস্টিতে ভিজেই বাড়ি যেতে হবে । কতক্ষণ গাড়ীতে বসে থাকা যায় । গাড়ি থেকে বের হতে একটু অন্যমনস্ক থাকায় হঠাত করে গাড়ির দরজার উপরের অংশের সাথে বাড়ি খেলাম । ড্রাইভার তাড়াতাড়ি দৌড়ে এল । আমি মাথায় হাত দিয়ে বুজতে পারলাম কপালের চামড়া হাল্কা ছিড়ে গেছে । ব্যাপারটাকে পাত্তা না দিয়ে, ড্রাইভারসহ গাড়ি রেখে, আমি বৃস্টিতে ভিজে হেটে হেটে বাড়ীর দিকে রওয়ানা হলাম।
উহ! কি বৃস্টি! রাস্তা পিচঢালা। কিছুদুর পর পর সিটি কর্পোরেশনের লাইট জ্বলছে তাই আছড়ে পড়ার সমস্যা নাই। যতটা সম্ভব দ্রুত হাটার চেস্টা করছি । মোবাইলে সময় দেখলাম রাত একটা চল্লিশ বাজে ।বাড়ি এখনো বেশ কিছুটা দূরে। আগে এই পথে একটা শশ্মান ছিল এখন সেখানে পাচতলা মার্কেট । তাই ভুতপ্রেতের সেই পুরাতন কালিন ভয়টা নাই ।হাটতে হাটতে নিজের ভাগ্যকে নিজে বকা দিচ্ছি , হায়রে দুনিয়া যাদের জন্য করি তারা আমাকে ঠকাতে বসে র‍যেছে । বুজলাম, জায়গাতে তোদের ভাগ আছে তাই বলে, আমি যে তোদের জন্য এত কিছু করছি সেই কথাটা একটু ভাবলি না ।
হঠাত শুনি পাশ থেকে কে যেন বলে উঠল “ ওদের হকের জায়গা ওরা চাইছে এতে তোমার দিতে সমস্যা কোথায় ?
আমি চমকে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখলাম, একলোক আমার পাশে হাটতে হাটতে কথা বলছে। লোকটাকে দেখে কেমন যেন চেনা চেনা লাগছে কিন্তু অনেক ভেবেও মনে করতে পারলাম না । লোকটা মধ্যবয়স্ক , গায়ের রং ফর্সা , মাথায় কাচাপাকা চুল । মুখের দাড়িও কাচাপাকা । কপালে কিছুক্ষন আগে আঘাত পাওয়া ছোট্ট একটা কাটা দাগ।কাটা দাগের উপর হাল্কা রক্ত আসছে বৃস্টির পানিতে আবার ধুয়ে যাছেচ । আমি লোকটাকে দেখে অবাক হয়ে গেলাম । কোত্থেকে এল? চট করে দাদার কথা মনে পড়ল । না এই দাদার মত নয় । চেনা চেনা লাগছে আমাদের গ্রামের কোন লোক হবে হয়ত । কিন্তু তুমি করে বলছে কেন ? যদিও দুজনেই সমবয়সী হব। শরীরের গঠন গাঠন প্রায় একই কিন্তু তুমি ডাকার মত এমন চেহারার কোন বন্ধুত আমার নাই ।
লোকটি বলতে লাগল “ “ তুমি ওদের সাহায্য করছ ভাইয়ের প্রতি ভাইয়ের দায়িত্ব থেকে ভালবাসা হতে , রক্তের সম্পর্কের টানে , তাই বলে ওদের অভাবের ও অসহায়ত্বের সুযোগ কেন নিবে?তোমার ইচ্ছা না হলে ওদের সাহায্য করবে না। তাই বলে এতিমের হক খাওয়ার জন্য বসে আছ ।
তোমার কি আল্লাহর ভয় নাই আল্লাহ কোরআনে কি বলেছে

“” আর ( এতিমদের সম্পর্কে ) মানুষের ভয় করা উচিত, যদি তারা পিছনে অসহায় সন্তান ছেড়ে যেত (তবে) তারাও তাদের সম্বন্ধে উদ্বিগ্ন হত ।অতএব লোকের উচিত ( এতিম-অনাথ সম্পর্কে ) আল্লাহকে ভয় করা এবং ন্যায়সংগত কথা বলা । নিশ্চয় যারা পিতৃহীনদের সম্পদ অন্যায়ভাবে গ্রাস করে , তারা তাদের উদরে অগ্নি ভক্ষন করে, তারা জলন্ত আগুনে জ্বলবে । সুরা নিসা আয়াত চার ও পাঁচ । “”
তারপরও তুমি কেমনে সাহস কর, তোমার অসহায় ভাতিজার সম্পত্তি গ্রাস করার । তোমার কি মৃত্যুর ভয় নাই ? সাবধান সাবধান কেয়ামতের মাঠে এই জমিনের সাতস্তবক তোমার কাঁধে তুলে দেওয়া হবে , সেদিন কোন ক্ষমতা কোন ধন সম্পদ তোমাকে বাচাতে পারবে না ।
লোকটা এক নাগাড়ে কথা বলতে লাগল । আমি যে কিছু বলব সেই সুযোগ পাচ্ছিনা । তারপর সে একটু থামতেই আমি বললাম “ তুমি কে ? আমাকে এই রাতে উপদেশ দিতে এসেছ । আমি কি কোরআন হাদিস তোমার থেকে কম জানি ? আমি যা করছি ন্যায়ভাবেই করছি ।
হ্যা , অপরাধ করার সময় সবাই তাই বলে । যখন অন্য কেউ কোন অপরাধ করে , মানুষ তখন সব সময় তা অন্যায় হিসাবেই দেখে, আর যখন নিজে কোন অপরাধ করে তখন নিজের সেই অপরাধকে জায়েজ করার জন্য নানা ধরনের সত্য মিথ্যা ফতোয়া ও আইনের অবতারনার আশ্রয় নেয় ।
আমি এবার দাঁড়িয়ে গেলাম “ কি ব্যাপার তুমি কোথাকার কে হঠাত মাঝ রাতে আমায় এসেছ উপদেশ দিতে ঘটনা কি বলত ।
“ তুমি আমাকে ভাল করেই চেন ।এখন চিনতে পারছ না কারন তোমার মাথায় এতিমের হক মেরে খাওয়ার চিন্তা ঘুরপাক খাছেচ । তাই চেনা মুখও তোমার কাছে অচেনা হয়ে গেছে । ধিক তোমাকে ধিক ! সাধারন এক সম্পত্তির লোভে এতটা নিচে নেমে গেছ । ভেবে দেখ এই সম্পত্তি তুমি কোন কবরে নিয়ে যেতে পারবে না । এমনকি হাশরের বিচারের পর যখন বেহেশ্তে যাবে তখনও কোন ফেরত নেবে না । কারন বেহেশতের সম্পদের তুলনায় এই সম্পত্তিকে মনে হবে মলমুত্র সম।
আমি বিরক্ত হয়ে গেলাম। এই রাতে আচ্ছা এক ত্যাঁদড় লোকের পাল্লায় পড়েছি । থামছেও না ছাড়ছেও না । কি এক মহা জ্বালায় পড়লাম। ওর উপদেশ ও দিয়েই যাচ্ছে । থামাথামির কোন লক্ষন নাই। আমি আমার পদক্ষেপ আরও দ্রুত করলাম তাড়াতাড়ি ওকে পিছনে ফেলে অনেকটা সামনে এগিয়ে গেলাম। যত দ্রুত বাড়ি পৌঁছতে পারি , তত তাড়াতাড়ি এই যন্ত্রনাকে ঝেড়ে ফেলা যাবে।
যাই হোক শেষ পর্যন্ত বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছলাম । গেটের সামনে এসে গেটে হাত দিয়ে বাড়ি দিতে দিতে পিছন ফিরে দেখি আপদটা নাই । স্বস্থির নিশ্বাস ফেললাম যাক আপদটা বিদায় হয়েছে ।
বাসায় ঢুকে তাড়াতাড়ি ভেজা কাপড় বদলে নিলাম । তারপর সুস্থির হয়ে ভাবতে লাগলাম লোকটা কে ? ভাবতে ভাবতে কপালে হাত দিতে গাড়ির দরজার ভিতরের ফ্রেমে বাড়ি খেয়ে ছিড়ে যাওয়া আঘাতে ব্যাথা করে উঠল । উঠে আয়নার সামনে গেলাম কতটুকু কেটেছে দেখার জন্য । আয়নায় নিজের দেখতেই চমকে উঠলাম ! একই আয়নায় কাকে দেখছি ? আমাকে না কিছুক্ষন আগে রাস্তায় বকবক করা সেই লোকটিকে ?
সেই মধ্যবয়স্ক , গায়ের রং ফর্সা , মাথায় কাচাপাকা চুল । মুখের দাড়িও কাচাপাকা । কপালে কিছুক্ষন আগে আঘাত পাওয়া ছোট্ট একটা কাটা দাগ। একই রকম ! তাহলে আমি কি নিজেকেই নিজে দেখেছি ?
পরদিন সকালে ভাতিজাকে ডাকলাম । ভাতিজা এখন যথেস্ট বড় হয়েছে ।এইবার এইচ এস সি পরীক্ষা দিয়েছে।ফলাফল খুব ভাল করেছে ।
বললাম “ ওই জায়গাতে কি কি গাছ লাগাবি? চারা অমুক নার্সারি থেকে যা লাগে নিয়ে রোপণ কর । নার্সারির মালিককে বলিস আমি টাকা দেব । আর এখনকার কাজ শেষ করে শহরে আমার বাসায় যাবি। যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া চাই । এখন থেকে শহরে আমার ওখানে থেকে পড়ালেখা করবি।
আমার কথা শুনে ভাতিজা তার মার মুখটা পূর্ণিমার চাঁদের মত উজ্জল হয়ে উঠল ।
২৮/০৮/২০১৭

শুক্রবার, ১৭ এপ্রিল, ২০১৫

রক্ত (বিজয় দিবসের গল্প)

কক্সবাজারে আসার একদিন পরেই চোখে পড়ল মহিলাকে। এখনও খুবই সুন্দরী হলেও বয়সটা পন্চাশের ঘর পেরিয়েছে অনেক আগেই তা দেখলেই বোঝাই যায়। তবে পন্চাশের ঘরটা পেরিয়ে বয়সটা কতটুকু সামনে গিয়েছে তা বলা কঠিন। যদিও মহিলাকে আমার চোখে পড়ার ব্যাপারে আমার কোন কারসাজি নাই কেননা আমার বয়স মাত্র পচিশ বছর। তাই এই বয়সে এত বয়স্ক মহিলার প্রতি আমার কোন আগ্রহ থাকার কথা নয়। যেখানে প্রতিনিযত আশেপাশে ঘুরে বেড়াছ্ছে রুপসী নজর কাড়া উর্বশীরা।
আমি ছোটখাট একটা চায়ের দোকানে বসে চা খাছ্ছিলাম। মহিলা তার ছেলে পুত্র-বধু সহ হোটেলটার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে যেই না দেখলেন সাথে সাথে হতচকিত হয়ে দাড়িয়ে গেলেন। আমার দিকে কিছুক্ষন হতবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে দ্রুত নিজেকে সামলে নিলেন। তারপর চিন্তিত হয়ে মাথা নিচু করে কিছুদুর গিয়ে আবার ঘাড় ফিরিয়ে তাকালেন। কিছুক্ষন ঘাড় ফিরিয়ে দেখতে দেখতে আবার মুখ ঘুরিয়ে চলে গেলেন। মহিলার আচরন দেখে আমি অবাক হয়ে গেলাম।
এরপরের দিন আমি হোটেলের সিড়ি দিয়ে যখন নামছি তখন দেখলাম মহিলা উপরে উঠছে। বুঝতে পারলাম আমি আর মহিলার পরিবার একই হোটেলে অবস্থান করছি। আমাকে দেখেই তিনি থমকে দাড়িয়ে গেলেন। আমি কিছু না বলে মহিলাকে পাশ কাটিয়ে নেমে গেলাম। দৃষ্টি সীমার আড়াল হওয়ার আগে আমি কৌতুহল বশতঃ পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখতে পেলাম, মহিলা এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
ব্যাপারটা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কে এই মহিলা ? মনেত হয় না, আমি কোথাও এনাকে দেখেছি। আমার চেনা জানা আত্তিয়ও নয়। তাহলে....কে ইনি ?
এরপর দিনও দেখা হল। এবার আমি উপরে উঠছি, দেখি মহিলা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। আমাকে দেখে দরজা থেকে আরেকটু বেরিয়ে এলেন। আমাকে বললেনঃ বাবা একটু দাড়াবে, তোমার সাথে কথা বলব।
এ কয়দিনে মহিলার অদ্ভুত আচরনে আমিও কৌতুহলী হয়ে উঠেছি, তাই দাড়িয়ে গেলাম।
ঃ তোমার নাম কি বাবা ?
আমি নাম বললাম।
ঃতোমার বাড়ি কোথায় ?
কেন জানি মহিলাকে আমার বাড়ির ঠিকানা বলতে ইছ্ছা হল না। তাই নানার বাড়ির ঠিকানা বললাম।
এরপর মহিলা বললঃ একটু ভিতরে এসে বসবে ? তোমার সাথে কিছুক্ষন কথা বলি।
আমি ভিতরে এসে বসলাম।
মহিলা আমার সামনে একটা টুল নিয়ে বসলেন।
ঃতুমি আমার ছেলের বয়সি হবে তাই বাবা বলে ডাকছি তুমি কিছু মনে করছনাত?
ঃ না আমি কিছু মনে করছি না। তবে আপনি আমাকে সালাম বলে ডাকুন এটাই আমার ডাক নাম।
ঃতুমি হয়ত আমার এ কদিনের আচরনে অবাক হয়েছ তাইনা ?
ঃ হ্যা কিছুটা অবাক হয়েছি বটে। কিন্তু আপনার এ জাতীয় আচরনের কারণটা কি ?
মহিলা কিছুক্ষন চুপ থেকে নিজের আবেগকে সংয্ত করলেন । তবে পারলেন না , কেননা উনার শুকনো দুচোখ ভিজে গেল।
ঃবাবা সালাম, আমি তোমাকে যখন প্রথম দেখি তখন ভীষন চমকে গিয়েছিলাম। কারন তোমার চেহারার সাথে আমার একজন প্রিয়, প্রিয় বললেও কম বলা হবে পরম প্রিয়জনের এতটা মিল যা আমাকে আবেগ প্রবন করে ফেলেছে।
আমি মনে মনে এটাই ধারনা করেছিলাম। মহিলা বলতে লাগলেন।
ঃ ওর নাম ছিল রুপম। আসল নামটা আমার মনে নাই কারন মনে রাখার চেষ্টা করিনি। এই নামের একটা ইতিহাস আছে। আমার নাম রুপা। আমার সাথে তার গভীর সখ্যতা দেখে আমার বাবা আমার রুপা নামের সাথে মিলিয়ে তার নাম দিয়েছেন রুপম। ওর বাবা ছিলেন সরকারী চাকুরে। তিনি যখন বদলী হয়ে আমাদের শহরে আসলেন এবং যেখানে বাসা নিলেন, তখন আমার বাবা ছিলেন ঐ এলাকার চেয়ারম্যান। রুপমের বাবা ছিলেন থানার ওসি। খুব সৎ লোক ছিলেন। উনি থানার ওসি হওয়ায় আমার বাবার সাথে সম্পর্কটা ছিল গভীর। রুপমের সাথে যখন আমার পরিচয় তখন সে পড়ত অষ্টম শ্রেণীতে আমি পড়তাম ষষ্ট শ্রেণীতে। আমাদের স্কুলে ছেলেমেযে একই সাথে পড়ত। তাই আমাদের দুই পরিবারের হূদয়তার কারনে আমি আর রুপম এক সাথে আসা যাওয়া করতাম। এই আসা-যাওয়ার মাঝে আমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসা জন্ম নিল। তখন দুজন দুজনকে ছাড়া একদন্ডও থাকতে পারতাম না। একজন আরেকজনকে ভালবাসলে যা হয় আরকি। তোমাকে আর খুলে কি বলব। তুমিত যুবক তুমিও জান ভালবাসা কি জিনিস।
মহিলার ঠোটের কোনে এক চিলতে হাসি উকি দিয়ে হারিয়ে গেল। যেন বাদলা দিনে মেঘের আড়ালে সূর্য উকি দিল। এই বয়সেও মহিলার হাসিটা অপূর্ব। না জানি যৌবনে আরও কত সুন্দর ছিল। রুপমের ভাগ্য দেখে আমার একটু করে হিংসাই হল।
ঃআমাদের পরস্পরের প্রতি ভালবাসার কথা আমাদের পরিবারের লোকেরা জানত। এই ব্যাপারে দুজনের পরিবারের মৌন সম্মতি ছিল। তাই আমাদের মেলামেশাটা ছিল অবাধ এবং পবিত্র। একসময় রুপম কলেজে প্রবেশ করল। এই সময় আমার এক ফুপু বলেছিল আমাদের বিয়ের আকদটা করে ফেলতে। ফুপুর কথাটা দুই পরিবারে মানে নিয়ে এই ব্যাপারে আনেক দুর অগ্রসর হয়েও পরে ওর এক মামার অসম্মতির কারনে হয়নি। মামা যুক্তি ঠিক ছিল, এখন যদি আকদ হয়ে যায় তাহলে আমাদের দুজনের পড়ালেখার ক্ষতি হতে পারে। দুই পরিবারে যখন সম্মতি আছে তখন রুপমের পড়ালেখা শেষ হওয়ার পর আকদ ও উঠানো দুই একসাথে করা যাবে। হায়রে ভাগ্য তখন কি আমরা কেউ জানতাম আমাদের এই আশা আর কোনদিনও পুরন হবে না। এর কয়েক মাস পরই শুরু হল স্বাধীনতা সংগ্রাম। যদিও আমরা ঢাকা শহর থেকে দুরে তবুও আমাদের গ্রামে পাকিস্তানী সৈন্য আসতে বেশি সময় নিলনা। পকিস্তানীরা যেদিন এল সেদিন ওরা এলাকার গনমাণ্য সবাইকে নিয়ে মিটিং করল। মিটিং থেকে আমার বাবা ও রুপমের বাবা এক সাথে আমাদের বাসায় এলেন। আমার বাবা হাসিখুশি ছিলেন কিন্তু রুপমের বাবা ওসি সাহেব ছিলেন খুব গম্ভীর।
আমার এখনও মনে আছে বাবা রুপমের বাবার গম্ভীর মুখ দেখে বললেনঃ আরে এত চিন্তা করছেন কেন। মেজর খান সাহেব যা বলেছে খারাপ বলেনি। কথাটা সত্য কিছুদিনের মধ্যে সব স্বাভাবিক হয়ে যাবে। কেননা এই বিশাল বিশাল পাঠান সৈন্য আর অত্যাধুনিক অস্ত্রের কাছে দুর্বল বাংগালীরা বেশদিন টিকবে না। আপনি বাসায় যান দ্রূত শান্তি কমিটির লিষ্টটা করে ফেলেন। কাল সকালেই জমা দিতে হবে।
এরপর রুপমের বাবা চলে গেলেন। তার পরদিন সকালে এলাকায় খবর হয়ে গেল ওসি সাহেব পরিবার পরিজন নিয়ে পালি্যেছে। ওসি সাহেবের পালানোর খবর শুনে আমার বাবা বললেনঃ ওসি সাহেব কাজটা ঠিক করেননি। নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মেরেছে। কিছুদিনের ভিতর সব কিছু স্বাভাবিক হয়ে এলে পাকিস্তানী সরকার ওদের খুজে বের করে মারবে।
সেই যে গেল আর কোনদিনও রুপমরা আর এল না। যুদ্ধের সময় বাবার মুখে শুনেছিলাম রুপম আর রুপমের বাবা দুজনেই মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে।(মহিলা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন।) এরপর আর কোনদিনও রুপমের সাথে আমার দেখা হয়নি। হয়ত যুদ্ধে মারা গেছে। তা নাহলে আমাদের যে গভীর প্রেম ছিল ও একদিন না একদিন অবশ্যই আমার কাছে আসত।
মহিলার দুচোখ বেয়ে অঝোর ধারায় অশ্রূ গড়িয়ে পড়ছে। আমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। আমি কি বলে উনাকে স্বান্তনা দেব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। মাথা নিচু করে চুপ করে বসে রইলাম। কিছুক্ষণ পর মহিলা নিজেকে সংযত করে নিলেন।
ঃবাবা তোমার চেহারার সাথে সেই রুপমের চেহারার এতটা মিল যে হয়ত তোমাকে দেখলে ওর মাও মনে করবে তুমি উনার ছেলে রুপম।
মহিলা আবার মিষ্টি করে একটা হাসি দিল। অপূর্ব হাসি।
ঃতুমি একদিন ঢাকায় আমার বাসায় এস। রুপমের ছবি তোমায় দেখাব। ওর আর আমার কয়েকটা পারিবারিক আমার কাছে এখনও ছবি আছে। তুমি আসলে খুশি হব।
আমার খুব কৌতুহল জাগল ছবিটা দেখার তাই বাসার ঠিকানাটা নিলাম।
কক্সবাজার থেকে ঢাকায় ফেরার কয়েকদিন পরই মহিলার বাসায় গেলাম। বিশাল জায়গার উপর আলীশান এক বাড়ি। মহিলা আমাকে দেখেই আনণ্দে আবেগ আপ্লুত। তিনি বলেই ফেললেনঃ তোমাকে দেখে মনে হছ্ছে আমার সেই রুপম যেন এসেছে।
আমি মহিলার আবেগ দেখে নিজেও কিছুটা বিব্রত হয়ে পড়লাম। মহিলা আমার বিব্রত অবস্থা বুঝতে পেরে নিজেকে সামলে নিলেন। এস বাবা এস আমার আচরণে কিছু মনে কর না। তোমাকে দেখে আমি কিছুটা নিয়ন্ত্রন হীন হয়ে পড়েছিলাম। আমি দুঃখিত।
ঃ না না আপনার আচরণে আমি কিছু মনে করি নি। এমন হওয়াটা স্বাভাবিক। আপনার জীবনের প্রথম প্রেম। প্রত্যেক মানুষ তার জীবনের প্রথম প্রেমকে কখনও ভুলতে পারে না।
মহিলা মাথা ঝাকিয়ে বললঃ ঠিক বলেছ আমি এখনও রুপমকে ভুলতে পারিনি। আর কখনও পারবোও না।
উনি এ্যালবাম বের করলেন। কয়েক পৃষ্ঠা উল্টানোর পর একটা পৃষ্ঠায় অনেক পুরানো কয়েকটা পারিবরিক ছবি দেখা গেল। মহিলা আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার আগেই আমি দেখতে পেলাম হুবহু আমারই মত একজন দাড়িয়ে আছে এক তরুনীর পাশে।
আমি চমকে উঠলাম, আমার সারা শরীর কেপে উঠল। মহিলা আমার আচরন দেখতে পেয়ে বললঃ বাবা তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে ?
আমি কিছুই বললাম না।
সেদিন রাতেই বাবার রুমে গেলাম। বৃদ্ধ বাবা নানা রোগে জর্জরিত। তবে এখনও সোজা হয়ে হাটেন। ন্যায়ের ব্যাপারে চরম কঠোর ও আপোষহীন। আমার বাবা আমার কাছে দ্বীতিয় আদর্শ , প্রথম আদর্শ নবী মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাল্লাম। এমন বাবার সন্তান হতে পেরে আমি নিজে গর্ব বোধ করি।
তিনি টেবিলে বসে বই পড়ছিলেন। আমাকে ঢুকতে দেখে কিছুটা অবাক। আমি আরেকটা চেয়ার টেনে বাবার পাশে বসলাম।
ঃকিছু বলবি ?
আমি জানি আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা। আমার দাদা ওসি সাহেব তিনিও মুক্তিযোদ্ধা তবে তিনি শহীদ হয়েছেন। কিন্তু বাবা যে এতবড় আত্মত্যাগী তা আমার জানা ছিল না। কিন্তু কেন ? কি কারনে এই আত্মত্যাগ তা আমাকে জানতে হবে।
ঃবাবা আপনাকে একটা প্রশ্ন করব উত্তর দেবেন ?
ঃবল।
ঃআপনি রূপম নামে কাউকে চেনেন ?
বাবা এমন ভাবে চমকে উঠলেন যে যেন ঘুমন্ত মানুষ হটাৎ জেগে উঠল। বাবার কন্ঠ ভারী হয়ে গেল। আবেগে নয় রাগে।
ঃতুই এই নাম কোথায় পেলি।
আমি কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।
ঃআমি এই নামকে কবর দিয়েছি আজ থেকে চল্লিশ বছর আগে। শুধু নাম নয় ওই নামের মানুষটাকেও কবর দিয়েছি। এই ব্যাপারে আমি আমার মা আর বাবা ছাড়া কেউ জানত না। আমি ছাড়া আর দুজনত আজ এই দুনিয়ায় নাই। তারপরও ঘটনাটা তুই জানলি কি করে ?
আমি ঘটনাটা বললাম। বাবা মন দিয়ে সম্পূর্নটা শুনে বললেনঃ তুই রুপার কাছে তোর পরিচয় প্রকাশ করেছিস ?
ঃ না বাবা আমি পরিচয় প্রকাশ করিনি।
ঃ ঐ অতীতকে আমি আর কখনো সামনে আনতে চাই না। কারন ঐ অতীত আমার কাছে কালো একটা অধ্যায়।
ঃ ওনার অপরাধ কি ছিল....।
বাবা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বললেনঃ ওর বাবা ছিল রাজাকার। ওর দেহে আছে রাজাকারের নাপাক রক্ত। এই হল রূপার অপরাধ।

শনিবার, ১০ মে, ২০১৪

শৈশবের সাথী ( গল্প )


আমি যখন প্রথম মানিক ভাঈ কে দেখি  তখন আমার বয়স কত ছিল মনে নাই । কারন তখন আমি ছোট ছিলাম। যতটুকু মনে পড়ে আমি স্কুলে যাছ্ছিলাম , যাওয়ার পথে বিশাল বাগান বাড়ি ওলা একটা বাড়ির সীমানা প্রাচীরের ভাংগা অংশ দিয়ে ছিটকে বের হল হালকা পাতলা গড়নের কালো রংগের ছেলেটি । পড়নে লুংগী কাছা দেওয়া । এক হাতে গাছ হতে সদ্য পাড়া চার পাঁচটা পাকা আম । আমরা কয়েকজন বান্ধবী ও উপরের ক্লাসের আপাদের সাথে স্কুলে যাছ্ছিলাম । এই সময় ছেলেটি দৌড়ে বের হয়ে আমাদের সামনে এসে থমকে দাড়াল । আমরা হঠাৎ ওকে দেখে দাড়িয়ে গেলাম। এক সাথে এতগুলো মেয়েকে দেখে ছেলেটি লজ্জা পেয়ে তাড়াতাড়ি লুংগীর কাছাটা নামিয়ে দিল। এই সময় ঐ সীমানা প্রাচীরের ভাংগা অংশ দিয়ে একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করতে করতে বের হয়ে এল। ছেলেটি কুকুরটি দেখেই আবার দৌড় দিল। ছেলেটি যেন বাতসে উড়ছে। পিছনে কুকুরটিও ওকে কামড় দেওয়ার জন্য ছুটছে ।

এদিকে আমরা মেয়েরা ভয়ে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে দেখছি শেষটা কি হয় । ছেলেটি প্রাণপনে দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তা মধ্যেখানে পুল ছিল । সে সেখান থেকে লাফ দিয়ে খালে পড়ল।

আমরা মেয়েরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম । আবার হাটতে লাগলাম। এইবার আমাদের মধ্যে যারা ওকে চিনে তাদের মধ্যে একজন বলল " বাপরে কি বিছ্ছুরে বাবা। হারাডা দিন গ্রামডাকে যেন্ মাথায় তুইল্লা রাখে । "

আরেকজন মেয়ে বলল " ঠিক কইছস । এই হেদিন আমাগো কলা গাছের এক কাঁদি কলা হাওয়া । এইডা এই মানিক্কার কাম। "

" আরে রাখ । তোগোত খালি এক কাঁদি কলা । আমাগোত এক রাইতে গোটা পুকুরের মাছই ছাফ কইরা ফালাইছে এই মানিক্কা চোরা।"

আমি অবাক হয়ে দেখি সবাই মানিকের বিরুদ্ধে । এর মধ্যে একজন মানিকের পক্ষে কথা বলে উঠল।

"সাহস থাকলে ওর সামনে কথাগুলি তোরা কইছ দেখি । কামাইল্লা চোরা করলে মানিকের দোষ । সুমন চোরা করলে মানিকের দোষ । পোলাডার বাপ নাইত সবাই হেরে নরম পাইচছ। কামাইল্লা মেম্বারের পোলা , সুমইন্না আড়তদাড়ের পোলা, হেইল্লিগা হেগো বিরুদ্ধে কিছু কস না। "

সাথে সাথে আরেকজন বলল " ঠিক কইচ আপা । মানিক্কা গরীবত তাই সবাই তারে দোষে । এই তোগো যে গাছের কলা আর পুকুরের মাছ চুরি অইছে তোরা কি দ্যাখছস মানিক্কা করছে ?

ওরা কোন কথা বলল না ।

কিরে কথা কছ না ক্যা ?

তারপরও ওরা চুপ করে থাকল।

" গরিব বইলা সবাই মানিকেরে দোষ দেছ । যদি স্কুলের হেড মাষ্টার পোলাডারে না দেখত, তাইলে এতদিনে মাইনষে হাড্ডি গুড্ডি এক কইরা ফালাইত। আরে এই গ্রামের কথা বাদ দিলাম ,আশেপাশে দশটা গ্রামে মানিকের মত পোলা কয়ডা আছে ক দেহি । জানি দেখাইতে পারবি না । প্রত্যেক বছর পরিক্ষায় ফাষ্ট কে অয় ? আমাগো মানিক্কা "

যাদের গাছের কলা চুরি হয়েছে সে বলল " সারাদিন দুইন্নার শয়তানি কইরা রাইতে মাত্র এক ঘন্টার মত পড়ে এতেই ফাষ্ট অইয়া যায় । কি মেধারে বাবা !

আরেকজন বলল "এই তাড়াতাড়ি থুক ফেল নইলে নজর লাইগ্যা যাইব। "

আমরা সবাই এক সাথে থু থু ফেলতে লাগলাম। এরপর পর প্রায় সময় মানিক ভাইকে দেখতাম আমার স্কুলে যায়া আসার পথে । কখনও গাছের ডালে বসে কিছু খাছ্ছে । কখনও খেলাধুলা করছে, কখনও মাছ ধরছে । তখন জৈষ্ঠ মাস । ডোবা ও পুকুরের পানি প্রায় শুকিয়ে গেছে । আমাদের বাড়ীর পাশে এক পুকুরের সব পানি সেচা হল । আমরা গ্রামের বড় ছোট সবাই হাত দিয়ে মাছ ধরছি । পুকুরের এক পাশে জংলা মত একটা জায়গা আছে । সেদিকে কেউ যাছ্ছে না । কারন সবাই জানে সেখানে সাপ আছে । তাও যেই সেই সাপ না । বিষাক্ত পদ্ম গোখরা সাপ । ওদিকে মাছ থাকলেও কেউ যাছ্ছে না । আমি মাছ ধরতে ধরতে কখন ওদিকে চলে গেছি নিজেও জানি না । হঠাৎ ফোঁস আওয়াজ শুনে চিৎকার করে দৌড় দিলাম । আমার এত কষ্ট করে ধরা মাছ সব ছিটকে পুকুরে পড়ে গেল। আমার চিৎকার শুনে মাছ ধরা রত সবাই থমকে গেল । মনে করল আমাকে সাপে কামড়েছে। আমি দৌড়াতে যেয়ে জংলা জায়গাটার সামনে কাদায় পা আটকে তখন পড়ে গেছি। ভয়ে হাঁচড়ে পাঁচড়ে উঠতে যেয়ে বার বার পড়ে যাছ্ছি । সাপের ভয়ে আমাকে ধরার জন্য কেউ এগিয়ে এল না । শুধু মানিক এল। সে এসে আমকে দাড় করাল ।

" এই মাইয়া এত ডরাস ক্যা।

সাপে কামড় দিছে ?

তখন ভয়ে আমার দুই চোখ দিয়ে পানি পড়ছে। মাথা নেড়ে না বললাম।

ও এবার আমাকে ছেড়ে দিয়ে জংলার কাছে এগিয়ে গেল। ওকে জংলার দিকে এগিয়ে যেতে দেখে সবাই চিৎকার করে নিষেধ করল। কিন্তু কে শোনে কার কথা । ও আস্তে আস্তে এগিয়ে গিয়ে হঠাৎ ভিতেরর দিকে হাত দিয়ে ঝটকা মারল। সাথে সাথে দেখি ওর হাতে প্রায় চার-পাঁচ হাত লম্বা গোখরা সাপ মোচড়াছ্ছে । মানিকের ডান হাতের মুঠায় সাপের মাথাটা শক্ত করে ধরা । ভয়ে মাছ ধরা রত দুই একজন বাদে সবাই পুকুর ছেড়ে পাড়ে উঠে গেল। আমিও যে কখন পাড়ে উঠে গেছি নিজেও জানি না । মানিক সাপটাকে নিয়ে পাড়ে উঠে বিলে দিকে গিয়ে আস্তা করে সাপটাকে ছেড়ে দিল । সাপটাও মাটির ষ্পর্শ পেয়েই একেবেকে চলে গেল। ও আবার পুকুরে নামার পর সবাই বলতে লাগল " তুই সাপটা কে মারলি না কেন ?"

" সাপ আমাগো উপকার করে হের লিগা মারি নাই । তয় যদি মাইয়া ডারে কামড় দিত তহন মাইরা ফালাইতাম। "

আমি আর সেদিন মাছ ধরিনি । বারবার শুধু মনে হছ্ছিল মানিক ভাইয়ের কি সাহস ! কত্ত বড় সাপটাকে । এক ঝটকায় ধরে ফেলল ।

আমি বাড়িতে এসে মাকে ঘটনাটা বললাম । মা ঘটনা শুনে অবাক গেলেন। এরপর আমি মাকে বললাম " মা আমি নলকূপে যাই গোসল কইরা আসি ।

আমি গোসল করে ফিরে এসে দেখি মা মাছ কুটছে । সদ্য তাজা মাছ দেখে মাকে বললাম " মা মাছ কই পাইলা ?

" মানিক দিয়া গেছে । কইল ওর মায়ে পাঢাইছে ।

আমি অবাক হয়ে গেলাম ওর মা আমার মাকে কি ভাবে চিনে যে মাছ পাঠাবে ।

" ওর মা কি তোমারে চিনে ? "

মা মাছ কুটা ক্ষ্যান্ত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে হাসতে হাসতে বলল " চিনবা ক্যা ? মানিকের মা আমার বাল্যকালের সাথী । "

এর কয়েকদিন পর এক শুক্রুবার মা আমাকে বললেন আইজকা বিকালে তোরে লইয়া আমার সাথীর বাসায় যামু । ঘরে থাকিস।

সেদিন বিকালে আমি আর মা মানিক ভাইদের বাসায় বেড়াতে গেলাম । গ্রামের একবারে শেষ মাথায় মানিক ভাইদের বাড়ি । গাছগাছালি ঘেরা পাখির কলরবে ভরা , নিকানো উঠােনে সুন্দর একচালা বাড়ি । আমরা উঠানে পা রাখতেই মানিক ভাইয়ের মা দৌড়ে এল।

"কিরে সই তুই কারে নিয়া আইলি ? "

এই বলে আমার দুই গালে চুমু দিয়ে আমাকে কোলে তুলে নিল । আমি কিশোরী হলেও দৈহিক গঠন বাড়ন্ত হওয়ায় আবার নামিয়ে দিলেন।

" বড় হইয়া গেছস ।"

আমি আর মা ঘরে ঢুকলাম । ভিতরে ঢুকতেই পিছনের দরজা দিয়ে বাইরে পিছনের উঠান দেখা যায়। সেখানে মানিক ভাই একটা বাশের বানানো খাচায় বন্দি একটি ধান শালিকের বাচ্চাকে আদার খাওয়াছ্ছে । আমি সেদিকে এগিয়ে গেলাম । পিছনে উঠানে নামতেই দেখলাম উঠানের মধ্যেখানে বাঁশের মাচার কবুতরের টং ( বাসা ) । সেখানে অনেক কবুতর । উঠানে কিছু গাছের ডালে কিছু বাকবাকুম করছে ।

আমি মানিক ভাইয়ের সামনে এসে দাড়ালাম । সে আমার দিকে না তাকাল না । পাখির বাচ্চাটাকে আদার খাওয়ানোর পর খাঁচায় রেখে আমাকে প্রশ্ন করল " কখন এসেছিস ? "

" এইত এখন । মানিক ভাই তোমার এখানে এত কবুতর কইথ্থিকা আনছ ? "

" কিছু বাজার থিকা কিছু বন্ধুগ থিকা ।"

কবুতরগুলির নাম কি ? এই যে লেজডারে ময়ুরের পেখমের মত ছড়াইয়া রাখছে ।

" এইডার নাম ময়ুরী । "

" কাউয়ার মত গলাডা ফুইল্লা রইছে ঐডার নাম কি ? "

" ঐডা বহুত দামি কবুতর । নাম পিনবল । '

মানিক ভাই এর মাঝে ঘরে বেড়ার সাথে ঠেস দিয়ে রাখা কয়েকটা বড়শির ছিপ থেকে একটা তুলে নিল ।

" কই যাইবা ?"

" মাছ ধরতে । তুই যাবি ? "

' যামু । মারে কইয়া আহি ।"

" খালাম্মারে কইলে আর যাইতে অইব না । তাইলে তুই থাক ।"

" ঠিক আছে কমু না । চল।

আমরা দুইজন বাড়ির পিছন দিয়ে নাল জমিতে নেমে গেলাম তারপর কিছুদুর গিয়ে একটা ছাড়া ভিটার ভিতর দিয়ে জংগলে প্রবেশ করলাম। জগংলটা ছোট ছিল ওটা পার হতে বেশিক্ষন লাগল না । জংগলের পরেই কবরস্থান তারপর খাল। কবর স্থানটা অনেক পুরানো । এখন এখানে লাশ দাফন করে না । আগে যখন গ্রামে কলেরা বা বসন্ত হত তখন এখানে ঐসব লাশ দাফন করত। কবর স্হানে প্রচুর বিশাল বিশাল গাছ । এই গাছগুলোর কখনও ডাইনে কখনও বায়ে পাশ কেটে খাল পাঁড়ে এসে আমরা পৌছলাম । খালটা মোটামুটি বড় ধরনের । পানিতে তেমন একটা স্রোত নাই। জোয়ার-ভাটা হয় তবে বোঝা যায় না । মনে হয় পানি সব সময় এক রকম থাকে । এই রকম খালে প্রচুর মাছ থাকে । মানিক ভাই সুবিধা মত একটা জায়গা দেখে বসে পড়ল। তারপর সাথে আনা পলিথিনের মুখ খুলে জ্যান্ত কেচো বের করে বড়শীতে গেথে পানিতে ছেড়ে দিল । আমি মানিক ভাইয়ের পাশে বসে খালের অপর পাড়ে মানুষের আনাগোনা দেখতে লাগলাম । কিছুক্ষনের মধ্যে মানিক ভাই দশ -পনরটা কই আর শোল মাছ ধরে ফেলল । সেগুলো সাথে আনা বেতে টুকরির ভিতর রাখল । হঠাৎ আমি বললাম " মানিক ভাই আমরে দাও আমি কয়েকটা ধরি ।

আমার কথায় সায় দিয়ে মানিক ভাই বলল " পারবি ? পারলে ল । আমি খালে নাইম্মা পাড়ের ফুটের মধ্যে হাতাইয়া দেখি কোন মাছ পাই কিনা, ""

মানিক ভাই আমাকে ছিপটা দিয়ে লুংগী কাছা মেরে খালে নেমে গেল।

এই সময় আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলাম ঈশান কোন লাল হয়ে আসছে ।

" মানিক ভাই তুফান আইব মনে অয় । "

মানিক ভাই মাছ ধরা অবস্থায় পিছন ফিরে ঈশান কোনে তাকাল ।

" হরে ঠিক কইছস । চল আর মাছ ধরনের দরকার নাই । তুই না থাকলে আমি যাইতাম না । "

এই বলে মানিক ভাই পানি থেকে উঠে গেল । তাড়াতাড়ি সব কিছু গুছিয়ে নিতে লাগল । ইতি মধ্যে ঝড়ো বাতাস শুরু হয়ে গেছে। আমরা দুইজনে তাড়াতাড়ি বাড়ির দিকে রওয়ানা হলাম । করবস্থানের বড় বড় গাছ গুলো তখন ঝড়ো বাতাসের সাথে মোচড়ানো শুরু করে দিয়েছে । মানিক ভাই বলল " তাড়াতাড়ি কবরস্থানটা পাড় হ । নাইলে মাথার উপর ডাইল ভাইংগা পড়তে পারে । "

আমি এই কথা শুনে আরও জোরে দৌড়াতে লাগলাম। মানিক ভাই আমার জন্য আস্তা আস্তে দৌড়াছ্ছে । এখানে চাইলেও জোরে দৌড়ানো যায় না , কারন বড় বড় গাছের জন্য রাস্তাটা আঁকাবাঁকা হয়ে গেছে । ইতিমধ্যে বৃষ্টি শুরু হয়ে গেল। ইয়া মোটা মোটা এক একটা ফোটা । গায়ে লাগলে চামড়া জ্বলে উঠে ।

মানিক ভাই আবার বলল " চৈতি জোরে আরও জোরে দৌড়া । এখন ঠাডা পড়া শুরু অইব । তখন এই সব গাছের নিচে থাকলে বিপদ। গাছের উপর ঠাডা বেশি পড়ে । ঠাডা পড়ার সময় গাছের নিচের থিকা খোলা জায়গায় থাকনডা বেশি নিরাপদ।

এর মধ্যেই আমরা কবরস্থান পাড় হয়ে গেলাম । বিকট আঁওয়াজে বজ্রপাত হছ্ছে । মনে হছ্ছে কান ফেটে যাবে । ভয়ে আমি দুই চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে গেলাম । মানিক ভাই আমাকে দাড়িয়ে পড়তে দেখে এগিয়ে এল " আমাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে বলল " কিরে ডর লাগে ? ক্যান আমি আছি না । এই ঠাডা তোর গায়ে পড়ার আগেই আমি নিজের বুক পাইত্যা ঠেকামু । "

আমি চোখ খুলে মানিক ভাইয়ের দিকে তাকালাম । মাথার চুলগুলো ভিজে মুখের উপর লেপ্টে আছে। গভীর কালো দুই চোখে কিশোরের দুরন্ত ভয়হীন কোমল দৃষ্টি । দেখেই বুঝতে পারলাম সেখানে আমার অবস্থানটা কোথায় ? আমার কিশোরী দেহ কিসের এক অজানা শিহরনে কেঁপে উঠল। বুজতে পারলাম না তাকি বৃষ্টির হিমেল স্পর্শে না অন্য কিছু। মনে হল সত্যি তাই করবে। এর উপর ভরসা করা যায়। হঠাৎ করে আমার ডর-ভয় সব কোথায় চলে গেল।

" মানিক ভাই আমি আর দৌড়ামু না হাইট্টা যামু । তুমি লগে থাকলে আমার একটুও ডর লাগব না । আমার হাতটা ধর। "

মানিক ভাই আমার কথা শুনে আমার দিকে তাকাল

তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে বলল " ঠিক আছে চল। "

আমরা দুইজন কিশোর- কিশোরী হাত ধরাধরি করে, জমির আল বেয়ে হাটছি । চারদিকে ধূ ধূ জমিন, তার মাঝে ঝড়ো বাতাসের সাথে ঘন বৃষ্টি আমাদের অবগাহন করছে । বৃষ্টির ঘনত্বে চারদিকটা হয়ে গেছে ধোয়াশা । মাঝে মাঝে বিকট শব্দে আছড়ে পড়া বজ্রপাত, মাটির বুকে মাথা ঠুকে নিষ্ফল আতংক ছড়ানোর চেষ্টা করছে। আমি এখন আর কিছুকেই ভয় পাইনা ।

সেদিন বাসায় ফেরার পর আমার গায়ে প্রচন্ড জ্বর এল । পরবর্তিতে সেই জ্বর নিউমোনিয়ায় রুপ নিল; , আমাকে প্রথমে গ্রামের সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হল। সেখানকার ডাক্তাররা অপারগতা প্রকাশ করায়, ঢাকা বিভাগীয় হাসপাতালে নেওয়া হল। ওখানে প্রায় পনের হতে বিশদিন চিকিৎসা নেওয়ার পর সুস্থ হলাম । সুস্থ হলেও শরীর খুব দুর্বল ছিল তাই আর গ্রামে যাওয়া হল না । বাবা ঢাকায় সরকারী চাকরী করতেন তাই মেসে থাকতেন । আমি অসুস্থ হয়ে ঢাকা আসার পর বাবা সরকারী কলোনীতে বাসা পেলেন । মা ও আমার ছোট ভাইসহ সবাই গ্রামের তল্পি তল্পা গুটিয়ে ঢাকার স্থায়ি ভাবে বসবাস করতে লাগলাম। আমদের দুই ভাই-বোনকে এখানে একটা স্কুলে ভর্তি করে দেওয়া হল।

আমি গ্রামের মেয়ে । দড়ি ছাড়া গরুর মত সারাদিন বান্ধবীদের সাথে টৈ টৈ করে পাড়াময় ঘুরে বেড়াতাম । শহরে আসার পর কয়েকদিন নতুনত্বের কারনে ভাল লাগলেও , পরবর্তিতে এই ছোট্ট গন্ডির ভেতর হাপিয়ে উঠলাম । মাস খানেক পরই শুরু করলাম ঘ্যানঘ্যানানি ।

" এইহানে থাকুমা চলেন আমরা আমাগো বাড়িতে যামুগা । আমার এই হানে ভাল লাগে না । একটু বেড়ান যায়না । কেউর লগে কথা কওন যায়না । সবাই যার যার ঘরে বইয়া থাকে । আমার ভাল লাগে না । "

আমার এই ঘ্যাননানিতে মা -বাবা দুজনেই স্বান্তনা দিতেন ।

" আর কয়ডা দিন থাক দেখবি তখন খুব ভাল্লাগবো । "

তারপরও আমি কান্না করতাম।

আমার মন সারাক্ষন পড়ে থাকত সেই সবুজ ছায়া ঘেরা পাখির কলতানে সরব গ্রামে ।

দখিনা বায়ুর ছুয়ে যাওয়া অনাবীল সবুজ -সোনালী ধান ক্ষেতের বুকে।

কলকল - ছলছল করে এঁকে বেঁকে যাওয়া ছোট্ট খালের বুকে ভাসা কোসা নায়ে।

পুকুরের বুকে দাপাদাপি করে, গোসল করা ভেজা কাপড়ে সোনালী রোদের ছোয়া সেই দুপুরে ।

গাছের ডালে ঝুলে শামুক ভাংগা দিয়ে আমের চামড়া ছিলে খাওয়া সেই ছুটির দিনে ।

বাঁদল দিনের ঘন বরষে ভিজে কাদায় লুটোপুটি করা সেই দুষ্টুমিতে ।

মেঠো পথে দুই পাশের জংলা গাছের আশেপাশে উড়া জোনাকি পোকা দুই হাতের মুঠায় ধরে বাড়ি ফেরা সেই রাতে ।

শীতের কুয়াশায় কাঁপতে কাঁপতে খেজুর রস খাওয়া সেই ভোরে ।

মন পড়ে থাকত মানিক ভাইয়ের ডানপিটে কাহিনী শোনা সেই রুপকথাতে ।

মন চাইত ছুটে যাই এই দালানের কারাগার ভেংগে ছোট্ট আমার সবুজ গাঁয়ে । যেখানে আছে আমার সহপাঠি বান্ধবীরা । আছে খালা-ফুপু দাদী-নানীরা আরও আমার রোমান্চে ভরা সেই প্রিয় দিন গুলির সাথী মানিক ভাই । যেখানে ফেলে এসেছি আমার রাংগানো শৈশব ।

আছ্ছা মানিক ভাই এখন কি করছে ? নিশ্চয় আমার কথা ভেবে আমার মতই কাঁদছে । আমাদের বাড়ির উঠানে বারবার এসে দেখছে আমরা এসেছি কিনা ।এই সব ভাবনায় কেটে যেত আমার সারাদিন । স্কুলেও সারাদিন উদাস হয়ে থাকতাম । তবে পড়ালেখা ঠিক ছিল।

এভাবে আস্তে আস্তে বছর শেষ হয়ে গেল। স্কুলের সমাপনী পরিক্ষা শেষ হলে আমরা স্বপরিবারে গ্রামের বাড়িতে এলাম ।আমরা বাড়িতে আসা মাত্র আমাদের আত্মিয় স্বজনরা এল । আমার বান্ধবীরা সবাই আমাকে দেখে বলল " কিরে শহরে যেয়ে তুই অনেক সুন্দরী আর ডাংগর অইয়া গ্যাছস । "

আমি ওদের কথা শুনে লজ্জিত হয়ে যাই ।

সবাই এল মানিক ভাই এল না । দুই চোখে শুধু তাকেই খুজি । বাইরে কারও আওয়াজ শুনলেই মনে হত এই বুঝি মানিক ভাই এল । কিন্ত দুই দিন পার হওয়ার পরও মানিক ভাই এল না । দুই দিনের দিন মানিক ভাইয়ের মা এলেন । সইকে দেখে আমার মা কি খুশি ! দুজন দুজনকে বুকে জড়িয়ে কত অভিযোগ করে ফেললেন ।

" কিরে সই আইজ দুইদিন অইল আমি আইছি, তোর এত দিনে আমার লগে দেখা করতে আহনের সময় অইল ?

" কি করুম ক , একা মানুষ তার উপর বাবা অসুস্থ । আজকা বাবা একটু সুস্থ অইছে । তয় মানিকেরে ঘরে থুইয়া তরে দেখতে আইছি ।''

আমি সামনে এসে খালাকে সালাম দিলাম । খালা আমাকে দেখেই বুকে টেনে নিলেন " কিরে তুইতো আরও ডাংগর অইয়া গ্যাছস, সুন্দরও অইছস । সই কয়দিন পরত তর মাইয়ার লিগা রাজপূত্র আনন লাগবরে । "

এই কথা শুনে আমি জোর করে খালার হাত থেকে ছুটে বের হয়ে গেলাম । যেতে যেতে শুনলাম মা বলছে " তোর রাজপুত্রটাকে দিয়া দে না ।"

আমি দৌড়ে আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় আসতেই দেখি আমার কয়েকজন বান্ধবী আমার বাড়ির দিকে আসছে ।
 আমাকে দেখে তারা বলল আমরা তোর কাছেই  আইতাছি। আমরা পূবের বিলে যাইতাছি। নৌকায় কইরা বেড়ামু। তুই যাবি ?

মানিক ভাইয়ের সাথে দেখা না হওয়ার কারনে আমার কিছুই ভাল লাগছিল না তাই বললাম।

“নারে ভাল লাগতাছে না। আমি যামু না।”

“তুই যাবি মনে কইরা, আমরা এতদূর হাইট্টা আইলাম।

” শরিরডা ভাল না তাই যাইতে ইছ্ছা করতাছে না।

ওরা আর কিছু না বলে চলে গেল।

বিকেলের আকাশ রোদের কিরনটা মোলায়েম। অগ্রহায়ণের বাতাসে হিমেল হিমেল ভাব আর নতুন ধানের ঘ্রাণ। ধান কাটা মাঠে কবুতর চড়ুই টিয়া ও আরও অন্যান্য পাখিদের বিচরনে মুখরিত। চাষিরা ক্ষেতের মাঝেই নতুন ধান মাড়াই করছে।ফসল ভাল হওয়ার খুশিতে কৃষকের খুনসুটিতে কিষানীর মুখে মধুর হাসি।

আমি এইসব দেখে হাটতে হটতে কখন যে মানিক ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার পথে চলে এসেছি নিজেই জানি না। দুর থেকে হঠাৎ মানিক ভাইয়ের বাড়ি দৃষ্টিগোচর হওয়া মাত্রই থমকে গেলাম ! লজ্জায় দাড়িয়ে গেলাম। ভাবলাম একি করছি ? আমার কি হয়েছে ? তাড়াতাড়ি আমি ফিরতি পথে আমার বাড়ির দিকে হাঁটা শুরু করলাম। মাথা নিচু করে হাঁটছি আর ভাবছি আমার কি হয়েছে ? মানিক ভাইকে দেখার জন্য এমন পাগলামী কেন করছি ? তাহলে কি আমার …….। আর কিছু ভাবতে পারছি না। ছিঃ আমার এই রকম অবস্থা বুঝতে পারলে মানিক ভাই কি মনে করবে ? ভাববে আমি একটা ফালতু মেয়ে। নাহ এখন থেকে নিজেকে সংযত করতে হবে। মানিক ভাইয়ের সামনে নিজকে ছোট করা যাবে না।

“চৈতি”

মানিক ভাইয়ের ডাক শুনে সন্ধ্যার বাল্যকালে চমকে উঠলাম। মাথা তুলে দেখি মানিক ভাই আমার সামনে দাঁড়ানো। কাদা পানিতে শুকিয়ে যাওয়া চুল চিরাচরিত নিয়মে প্রশস্ত কপালে লেপ্টে আছে। উদোম গা। পরনে ভিজা লুংগী। সারা দেহে শুকিয়ে যাওয়া কাদা মাটির প্রলেপ মাখানো। কাধে রাখা তিন কোনা মাছ ধরার জাল ডান হাতে ধরে আছে। বাঁ হাতে বেতের লম্বা একটা ঝুড়ি।

“কিরে মাথা নিচু কইরা, কি ভাবতে ভাবতে হাটতাছস ?”

এমন সময় মাথার উপর দিয়ে এক ঝাঁক টিয়া পাখি ট্যাঁ ট্যাঁ ডাক দিয়ে উড়ে গেল। আমি মাথা উচিয়ে টিয়া পাখির ঝাঁকের দিয়ে তাকিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোন বাক্যই খুজে পেলাম না। কারন সত্য কথা যায় না বলা তা শোভনীয় নয়। মিথ্যা কথা কি করে বলি, তাতেত গুনাহ হবে। তাই আকাশের দিকে তাকিয়ে চুপ করে থাকলাম। আমার থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে এবার বলল ‘”সন্ধ্যা অইতাছে বাড়িতে যা গা।”

“তুমি কইথ্থিকা আইতাছ। সারা শরিলে ফুট মাখা।”

“মা কইছিল আমার সই আইছে ওগো লাইগা মাছ ধইরা লইয়া আয়। ওরা এখন ঢাকা শহরে থাকে ওখানে তাজা মাছ পায় না পায় কে জানে।”

“পুবের বিলে পানি কইম্মা গেছে তয় ওখান থিকা তগো লিগা মাছ ধরছি।”

“কি কি মাছ পাইছ ?”

বড় বড় ষোল মাছ, বাইলা মাছ, শিং মাছ, বাইন মাছ, আর কয়ডা বড় বড় কই মাছ পাইছি, মাছ আনার পর খালায় কইলো তুই নাকি কই মাছ বেশি পছন্দ করছ ? আগে জানলে আরও বেশি কইরা কই মাছ ধরতাম।”

“কেন আমার লাইগ্যা বেশি ধরন লাগব ক্যা ?”

মানিক ভাই আমার দুই চোখে গভীর দৃষ্টিতে তার দুই চোখ রেখে বলল “হেইডা তুই এখন বুঝবি না। আরও ডাংগর অইলে বুঝবি। যা বাড়িতে যা গা সন্ধ্যা অইয়া গেছে।”

এই বলে মানিক ভাই হন হন করে হেটে চলে গেল। আমি উনার শেষ কথা শুনে পাথরের মত স্থির হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে এই গাছ, পাখি ঐ সুনীল আকাশ, দেহ ছুয়ে যাওয়া বাতাস আহ ! কত সুন্দর ! আগেত কখনও এমন লাগে নি। আমার সারা দেহে যেন ভাল লাগার এক ভয়ানক সর্বনাশা ঝড় বয়ে যেতে লাগল।

এর কয়েকদিন পর আমরা শহরে চলে এলাম। মানিক ভাইয়ের সাথে আমার আর দেখা হয়নি।

এর মাসখানেক পর আমার বাবার প্রমোশন হয়ে খুলনায় বদলী গেলেন। এতে বছরের শেষ দিকে বাড়িতে যাওয়া টা আমাদের জন্য কঠিন হয়ে গেল। আমরাও আর বাড়িতে তেমন একটা যেতাম না। প্রথম দিকে মানিক ভাইয়ের কথা স্মরণ করে প্রায় উদাস হয়ে যেতাম। মানিক ভাইয়ের মত কাউকেই দেখলেই লুকিয়ে লুকিয়ে বার বার তাকাতাম। ধীরে ধীরে বড় হতে লাগলাম। আমার কিশোরী কাল পেরিয়ে তারুণ্যের জগতে প্রবেশ করলাম। স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে ভর্তি হলাম। সেখানে নানা রকম বন্ধু ও বান্ধবীদের সাহচর্যে আমি বদলে যেতে লাগলাম। বদলে যেতে লাগল আমার কচি মনের পৃথিবী। মানিক ভাইয়ের স্মৃতি আস্তে আস্তে হৃদয়ের প্রাচীন ঘরে হারিয়ে যেতে লাগল। আমার নতুন বন্ধুদের তুলনায় মানিক ভাইকে গেঁয়ো মনে হতে লাগল। এত কিছুর পরও সেই বিকেলের পর সন্ধ্যার লগনের ভাল লাগাটা যেন আমার জীবনের সবচেয়ে প্রিয় স্মৃতি হয়ে রইল। সেই অচিন ভাল লাগার শিহরিত আবেশ জীবনে আর কখনও পাইনি । তখন উপলদ্ধি না করতে পারলেও এখন বুঝি ওটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম প্রেম। আর মানুষ প্রথম প্রেমের স্মৃতি কখনই ভুলতে পারেনা।
আজও বুভুক্ষ হৃদয় সেই ক্ষণটি বার বার ফিরে পেতে চায়।
( সম্পূর্ণ কাল্পনিক )
                                                                                     সমাপ্ত 

মঙ্গলবার, ২১ জানুয়ারী, ২০১৪

চিরকুটের ভালবাসা ।

পাঁচ আর দুই বছর বয়সী দুটি সন্তান রেখে রাহেলা যখন না ফেরার দেশে চলে গেল। তখন মাহমুদ ছোট ছোট দুইটি বাচ্চা নিয়ে, ঝামেলার অথৈ সাগরে পড়ে গেল । রাহেলা মারা যাওয়ার পর মাহমুদের বড় বোন পনের দিনের মত ছিল । এই কয়টা দিন স্ত্রী হারানোর শোকে স্তব্দ হয়ে যাওয়া মাহমুদের বাচ্চা দুইটিকে তার বড় বোনই সামলে রেখেছিল ।

বড় বোনেরও সংসার আছে । ঘরে কলেজ পড়ুয়া বিবাহ যোগ্য একটি মেয়ে ও স্কুল পড়ুয়া দুই ছেলে আর ব্যাস্ত ব্যাবসায়ী স্বামি । এরা বড় বোনকে ছাড়া এক মূহুর্ত ও চলতে পারেনা । শুধু ছোট ভাই মাহমুদের ভেংগে পড়া দেখে এই পনর দিন মুখ বুজে ছিল । কিন্তু এখন আর পারছে না । তার অনুপস্থিতে তার নিজের সংসার তছনছ হয়ে যাছ্ছে ।

মাহমুদ দুপুরের দিকে বড় বোনকে গাড়িতে তুলে যখন বাসায় ফিরল, তখন রাহেলা বিহীন বাড়িটাতে কিছুতেই প্রবেশ করতে ইছ্ছা করছিল না । ঘরে বৃদ্ধা মা আর সন্তান দুটি কি করছে এই ভেবে তাড়াতাড়ি ফিরতে হল ।

এরই মধ্যে বড় বোন যাওয়ার সময় বারবার করে বলে গেছেঃ যা হওয়ার তাত হয়ে গেছে । যে চলে গেছে সেত আর ফিরবে না । অবুঝ বাচ্চা দুটির জন্য হলেও মাহমুদ যেন তাড়াতাড়ি বিয়ে করে । কারন সত্তর বছর বৃদ্ধ মায়ের পক্ষে বাচ্চাদের সামলানো সম্ভব না । তার নিজের বিশাল সংসার ফেলেও তার পক্ষেও ঘন ঘন আসা সম্ভব না ।

বড় বোন যখন এইসব বলছিল তখন মাহমুদ তার কথা গুলো এই কান দিয়ে ঢুকিয়ে ঐ কান দিয়ে বের করে দিল। মনে মনে বলল রাহেলার জায়গায় আমার আর কাউকে আনা সম্ভব না।

বড় বোন যাওয়ার কিছুদিন পরেই মাহমুদ টের পেল রাহেলার কঠিন অভাব । বাচ্চা দুটি প্রায় সময় মা মা বলে কান্না করে । বাচ্চাদের দাদী আর ওদের সামলাতে পারেনা। তখন মাহমুদকেই এসে ওদের সামলাতে হয়।

গন্জে মাহমুদের বড় কাপড়ের দোকান । সেখানে তার তিনজন কর্মচারী খাটে । ক্যাশে সব সময় থাকতে হয় । কারন কাষ্টমার স্লিপ , কাপড়ের হিসাব , টাকা বুঝে নেওয়া , ক্যাশ টাকা না হলে ব্যাংকের চেক বুঝে নেওয়া এই সব মাহমুদকে একাই করতে হয়। দোকানের কর্মচারীদের উপর ভরসা রাখা যায় না। ভরসা রাখতে যেয়ে আগে একজন কর্মচারী ব্যাবসায় বেশ কিছু টাকা মেরে পালিয়েছে।

রাহেলা মারা যাওয়ার এক মাসের ভিতর মাহমুদ বুঝতে পারল তার ইছ্ছা হোক আর না হোক তাকে আবার বিয়ে করতেই হবে। কারন বাচ্চাদের কারনে গত সপ্তায় চারদিন ঠিক মত দোকানদারী করতে পারে নাই। এই ভাবে চললে ব্যাবসায় লাল বাতি জ্বলতে বেশি দিন লাগবে না ।

এবার আর দেরী না করে বড় বোনকে বলল মেয়ে দেখার জন্য । রাহেলাকেও এনেছিল ওর বড় বোন। মাহমুদের অভিভাবক এই বড় বোনই, তাই তার উপরই মাহমুদ সব দায়িত্ব দিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে থাকে ।

কিন্তু এই বার বড় বোন তার জন্য কোন মেয়েই যোগাড় করতে পারলনা । কেটে গেল প্রায় ছয়-সাত মাস।

মা হারা বাচ্চা দুটি দিনকে দিন যেন আরও বেশি অধৈর্য হয়ে যাছ্ছে । দোকানে যাওয়াই যাছ্ছে না । ব্যাবসার অবস্থা খুব খারাপ । ব্যাবসা কমে যাওয়ায় দোকানের একজন কর্মচারী বিদায় করে দিতে হয়েছে। এখন সপ্তাহের পুরাটা সময় প্রায় বাড়িতেই থাকতে হয় । মা না থাকাতে ইদানিং বাচ্চাদের অসুখ-বিসুখও বেশি হছ্ছে । বাচ্চাদের দোকানে নিয়ে গেলেও ঝামেলা । কখন কোথায় চলে যায় ব্যাস্ততার কারনে খেয়ালও থাকে না। কয়েকবার কাউকে না বলে বড় রাস্তায় চলে গিয়েছিল । এই ভয়ে এখন আর দোকানেও নেয় না। এতদিনেও বড় বোন যখন কিছুই করতে পারল না, তখন একদিন সে নিজেই ঘটক লাগাল।

ঘটকও অনেক মেয়ের খবর আনল । যার বেশির ভাগই অল্প বয়সী অবিবাহিত মেয়ে । মাহমুদের বয়স চল্লিশের ঘর পেরিয়েছে । ঘটকরা খবর আনে পনর বছর আঠার বছর বয়সী মেয়ের। যা শুনা মাত্রই মাহমুদ বাতিল করে দেয় । ঘটক যখন কম বয়সী মেয়ের খবর আনলেই মাহমুদ বাতিল করে দেয় তখন একদিন ঘটক এক মেয়ের খবর আনল বয়স পঁচিশ । অবিবাহিত। বাবা নাই । এতিম । বিধবা মায়ের একমাত্র মেয়ে । খুব ভাল বংশ । মেয়ে পড়া লেখা করেছে । এস এস সি পাশ । মাহমুদ শুনে যখন একটু ইতস্তত করছিল ।

তখন ঘটক বললঃ ভাই এই পইযন্ত মেলা মাইয়ার খবর আনলাম । বয়স কম বইলা আপনি সব বাদ দিয়া দিলেন । এইডাত একটু বেশি বয়স । গ্রামে এর থিক্কা বেশি বয়স পাইবেন না । বিধবা মাইয়াত পাইবেনই না । কারন যেই সব মাইয়ারা বিধবা হয় হেরা বাচ্চাদের দিকে তাকাইয়া আর বিয়া করে না । আমাগো দেশের মায়েরা মমতা অলা । তারা নিজেগো জীবন ও জোয়ানকি বাচ্চাগো দিকে তাকাইয়া কাটাইয়া দেয় । আমি নিজেও বিধবা মায়ের একলতা পোলা । আমার বাপ যখন মইরা যায়, তহন আমার বয়স মাত্তর দুই বছর আছিল। আমার দিকে তাকাইয়া আমার মা আর বিয়া বহে নাই । তহন আমার মায়ের বয়স আছিল মাত্র আডার বছর। আপনে অহন পইযন্ত একটা মাইয়াও দেহেন নাই । এইডা দেহেন । পছন্দ না অইলে আরও দেহামুনে । অইলে চলেন কাইলকা দুইজনে যাইয়া মাইয়াডা দেইখ্খা আহি।

ঘটকের কথায় মাহমুদ রাজি হয়ে গেল। বললঃ কাল দুপুরের পর পরই যাব । তুই খবর পাঠিয়ে দে ।

বাস থেকে নেমে মাহমুদ দুই কেজি মিষ্টি নিল। তারপর বললঃ কতদুর যেতে হবে ?

ঃএই বেশি দুর না । হাইটা গেলে আধা ঘন্টা রিকসায় গেলে দশ মিনিট লাগব ।

ঃ তাহলে রিক্সাই নে ।

দশ মিনিটের জায়গায় প্রায় পঁচিশ মিনিট লাগল পৌঁছতে। টিনের দোচালা বিশাল আলীশান বাড়ি । গেট পার হয়ে সামনে বিরাট উঠান। উঠানে সিদ্ধ করা ধান রোদে শুকানো হছ্ছে। মাহমুদ কিছুটা থতমত খেয়ে গেল।

মাহমুদের অবস্থা দেখে ঘটক বললঃ এই বাড়িডা ওগো আছিল । মাইয়ার বাবার ক্যান্সারের চিকিৎসার টাকা যোগাইতে যাইয়া আপন চাচার কাছে সব বেইচ্চা হালাইছে । অহন আর বাপের ভিটা কইতে হেগো কিছুই নাই। এই বিশাল বাড়িডার পিছনে জংলার লগে লাগাইন্না একটা ছোট্ট কুড়ে ঘর আছে হেইখানে মা আর মাইয়া থাহে। মাইয়াডার বিয়া অইয়া গেলে মা হের বাপের বাড়ি যাইবোগা এই শর্তে চাচা হেগো থাকতে দিছে। সব চাইতে দুঃখজনক ঘটনা অইল মাইয়ার বাপেই এই ভাইয়েরে পালছে পড়ালেহা করাইছে । ব্যাবসা ধরাইয়া দিছে বিয়া করাইছে ।

মাহমুদ কোন কথা বলল না। সে ঘটকের পিছনে পিছনে বিশাল বাড়ির পিছনে ছবির মত ছোট্ট সুন্দর উঠান অলা ছনে ছাওয়া, মাটির একটি কুড়ে ঘরের সামনে এসে দাড়াল। উঠোনে পা রেখেই মাহমুদের দুই চোখ পানিতে ভরে গেল। রাহলা বেঁচে থাকতে তার বাড়ির উঠানও এই ভাবে নিকানো থাকত। তাড়াতাড়ি নিজেকে সামলে নিয়ে ঘটকের পিছনে পিছনে ঘরে প্রবেশ করল।

ছোটখাট একটা কামরা । একপাশে একটা চারপায়া টেবিল ও দুইটা চেয়ার অন্য পাশে একটা চৌকি । টেবিলের উপর নক্সিইকাথার মত নকশা করা টেবিল ক্লথ । চৌকিতেও তেমন একটা চাদর বিছানো। খুব সুন্দর নক্সা । দক্ষ হাতের নিপুন কাজ। যে কাউকেই মুগ্ধ করবে । ঘটক টেবিল থেকে একটা চেয়ার বের করে দিল । মাহমুদ বসল। ঘটক ভিতরে ঘরের দরজার পর্দার ওপাশে লক্ষ্য করে সালাম দিলে । মেয়েলী কন্ঠে আওয়াজ এল । সালামের জওয়াব নিয়ে বসতে বলল। কিছুক্ষণ পরে দুইজন কম বয়সী মেয়ে প্রবেশ করল । একজন সাধারন পোষাক পড়া অন্যজন লাল রংগের শাড়ি পরা ঘোমটা দেওয়া একজন হালকা পাতলা মেয়ে । শাড়ি পড়া মেয়েটা খুবই সুন্দর । গোলগাল মিষ্টি চেহারা । মাহমুদের দিকে এক পলক তাকিয়েছিল । তখন সে দেখল চোখ দুটি সরলতা আর কৈশোরের চন্চলতায় ভরা। মেয়েটিকে দেখে মাহমুদের কেন যেন চেনা চেনা মনে হল । আগে কোথায় যেন দেখেছে। খুবই পরিচিত। কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারলনা ।

মাহমুদ ঘটকের উপর রেগে গেল। কারন মেয়েটির বয়স বড় জোর চৌদ্দ কি পনের বছর হবে । এত ছোট মেয়ে !!

তারপরও আপাতত নিজেকে সামলে নিয়ে মেয়েটিকে প্রশ্ন করলঃ তোমার নাম কি মা ?

ঃ সুরাইয়া বেগম।

ঃ বাহ খুব সুন্দর নাম । কে রেখেছে ?

ঃ বাবা। আমার মায়ের নামের সাথে মিলিয়ে রেখেছে।

ঃ তুমি কোন বছরে এস এস সি দিয়েছ ?

ঃ এই বছরই ।

মাহমুদের রাগটা আবার ফিরে এল । কামরার চারদিকে ঘটককে খুজল । নাই । অবস্থা বেগতিক দেখে কোথায় যেন সরে পড়েছে।

ঃ পরিক্ষায় কি পেয়েছ ।

ঃ গোল্ডেন ফাইভ পেয়েছি।

মাহমুদের ভিতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বের হয়ে এল ।

ঃ এত ভাল ফলাফল করে আর পড়ছ না কেন?

মেয়েটি চুপ করে থাকল । মাহমুদ লক্ষ্য করল মেয়েটি ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে । মাথা নিচু করে মাটির দিকে তাকিয়ে আছে আর তার দুই চোখ বেয়ে নোনা জলের ধারা শাড়ির উপর টপটপ করে পড়ছে।

মাহমুদ আর কোন প্রশ্ন না করে বললঃ যাও মা তুমি ভিতরে যাও । আমি একটু তোমার মায়ের সাথে একটু কথা বলতে চাই ।

মেয়েটি আস্তে করে উঠে ভিতরে চলে গেল।

মাহমুদ একটু বড় আওয়াজে বললঃ আপনি সুরাইয়াকে পড়ালেখা না করে বিয়ে দিতে চাছ্ছেন কেন ?

কিছুক্ষন পর ভিতর থেকে সুরাইয়ার মা বললঃ আমি ওর জন্যই এখানে পড়ে আছি তানা হলে অনেক আগেই বাবার বাড়ি চলে যেতাম । আমার বড় ভাই বলেছিল ওকে সহ নিয়ে যেতে । কিন্তু আমি ওকে ওখানে নিতে চাই না । ভাইয়ের বৌদের গন্জনা আমি সইতে পারলেও আমার মেয়েটা সইতে পারবেনা । ও ছিল ওর বাবার একমাত্র মেয়ে । কোন অভাব কখনও পায়নি কারও কাছ থেকে কখনও বড় কথা শুনে নি । ওর বাবা অসুস্থ হওয়ার পর আর মারা যাওয়ার পর ওর ছোট চাচার আচার ব্যাবহারে যে কষ্ট পেয়েছে তা আমি এতদিন মুখ বুজে সহ্য করেছি । এখন আর পারছিনা তাই ওকে কোন ভাল ঘরে বিয়ে দিয়ে সুখি দেখতে চাই ।

ঃ তাই বলে একজন মধ্যবয়স্ক বিবাহিত দুই বাচ্চাঅলা মানুষের কাছে বিয়ে দেবেন ?

ঃ ঘটক আমার সাথে মিথ্যা বলেছে । যদিও আপনার অতটা বয়স বোঝা যায় না । এছাড়া আপনার দুই বাচ্চার কথা বলেনি। বলেছে এক বাচ্চা তাও একেবারে শিশু । আমিও চিন্তা করলাম অসুবিধা কি । আমি যে অভাবে আছি সেখানে একটা মেয়ের বিয়ের যে খরচ তা যোগাতে পারব না । যেখানে পড়াতেই পারছি না।

ঃ আপনার বাড়ি কোথায় ?

ঃ আমার বাড়ি সলীমপুর গ্রাম ।

সলিমপুর নাম শুনতেই মাহমুদের অনেক স্মৃতি এসে ভীড় করল। সলিম পুরে এক মেয়ের সাথে ওর বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল । ওর ফুপু সম্মন্ধটা এনেছিল। বাড়ির সবাই দেখে মোটামোটি কথা পাকপাকি হয়ে গিয়েছিল। মাহমুদের সাথে মেয়ের দেখাদেখি হওয়ার আগেই কি কারনে যেন সম্পর্কটা আর হয়নি। তবে মেয়েটার একটা ছবি পাঠিয়েছিল । খুব সুন্দর গোলগাল মিষ্টি চেহারা । নামটা কি যেন ? হ্যা মনে পড়েছে রুবাইয়াৎ । ওর ছবি দেখে আর নাম শুনে মাহমুদ মেয়েটার প্রেমে পড়ে গিয়েছিল । তখন ফুপাত বোনের হাতে একটা ছোট্ট চিরকুট পাঠিয়েছিল মেয়েটার কাছে। হঠাৎ সম্পর্কটা ভেংগে যাওয়ায় আর বেশিদুর আগায়নি । তবে সেই মেয়েটিকে ভুলতে মাহমুদের অনেকদিন লেগেছিল। চিরকুটে লেখা সেই কবিতাটি ছিল কবি কাজি নজরুল ইসলামের বাংলায় অনুবাদ করা কবি আল হাফিজের রুবাইয়াৎ ।

রুবাইয়াৎটা মনে পড়ছে পড়ছে করেও মনে পড়ছে না ।

ঃ আপনি ওখানে হাজী এমদাদউল্লাহকে সাহেবকে চিনেন ?

ঃ হ্যাঁ । উনি আমার বাবা।

মাহমুদ চমকে উঠল !!

ঃ রুবাইয়াৎ আপনার কি হন ?

ঃ আপনি ওকে কিভাবে চিনেন ?

ঃ আপনি বলুন না উনি আপনার কে?

ঃ আমিই রুবাইয়াৎ।

মাহমুদের শরীর কাঁপতে লাগল। তার হৃদয়ে তোলপাড় হতে লাগল। তার মনে হল সে আগের সেই দিন গুলোতে ফিরে গেছে। ওটাই ছিল তার তার প্রথম ভাললাগা প্রথম প্রেমের শিহরন । ওই ছোট্ট চিরকুটটাই তার প্রথম ও শেষ প্রেমের চিঠি।

ঃ আপনি কি করে আমাকে চিনেন ?

মহিলা অধৈর্য হয়ে আবার প্রশ্ন করল। মাহমুদ নিজেকে সামলে নিয়ে বললঃ আমিই তালুকদার পাড়ার সেই মাহমুদ । আজ থেকে পনের-ষোল বছর আগে যার সাথে আপনার বিয়ের কথাবার্তা হয়েছিল। আমি তখন আপনাকে একটা চিরকুট পাঠিয়েছিলাম ।

ঃ হ্যা মনে পড়েছে । আপনার ফুপাত বোনকে দিয়ে পাঠিয়েছিলেন। সেখানে কাজি নজরুল ইসলামের লেখা একটা রুবাইয়াৎ ছিল।

মাহমুদ আবার চেষ্টা করল রুবাইয়াৎটা মনে করতে পারলন না ।

নিয়তির খেলা দেখে দুজনেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল।

এরপর নাস্তা এল । মাহমুদ নিরবে নাস্তা খেয়ে নিল । নাস্তা শেষ করে কিছুক্ষন পর উঠে দাড়াল ।

ঃ আমি এখন যাব তাই আপনার সাথে কিছু কথা ছিল। যদি সামনে আসেন তাহলে........।

সাদা শাড়ি পড়া রুবাইয়াৎ পর্দা সরিয়ে কামরায় প্রবেশ করল। রুবাইয়াত মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে । মাহমুদ নিষ্পলক চোখে রুবাইয়াৎ কে দেখল । ছবিতে দেখা চেহারার আদলটা এখনও সেই রকমই আছে। দেখে মনে হয় সুরাইয়ার বড় বোন ।

তারপর ভনিতা না করে সরাসরি মুল কথাটাই বললঃ আমি সুরাইয়ার দায়িত্ব নিতে চাই । আপনি কি আমার বাচ্চাদের দায়িত্ব নিতে পারবেন ?

রুবাইয়াৎ অস্ফুষ্ট স্বরে বললঃ আপনি আমার বড় ভাইয়ের সাথে আলাপ করুন । উনিই আমার অভিভাবক ।

মাহমুদ বের হয়ে গেল । রুবাইয়াৎটা মনে করার আপ্রান চেষ্টা করতে লাগল। কিছু দুর এগিয়ে যেতেই । হঠাৎ কোথ্থেকে ঘটক উদয় হল। মাহমুদ পকেট থেকে পাঁচশত টাকার একটা নোট বের করে ওর হাতে দিয়ে বললঃ এখন আমার সামনে থেকে দুর হয়ে যা । আর যদি কখনও আমার সামনে আসিস তাহলে তোর খবর আছে। ঘটক টাকাটা নিয়ে সরে পড়ল।

রিক্সা নিতে ইছ্ছে করছে না । গ্রামের মেঠো পথের ধুলো ওড়া গোঁধুলিতে, পশ্চিমের রংগীন আকাশের দিকে তাকিয়ে হাটতে হাটতে হঠাৎ রুবাইয়াৎ টা মনে পড়ে গেল।

তোমার পথে মোর চেয়ে কেউ,

সর্বহারা নাই কো, প্রিয়!

আমার চেয়ে তোমার কাছে,

নাই সখি, কেউ অনাত্নীয়!

তোমার বেণীর শৃংখলে গো

নিত্য আমি বন্দী কেন?

মোর চেয়ে কেউ হয়নি পাগল,

পিয়ে তোমার প্রেম- অমিয়!!
( সম্পুর্ণ কাল্পনিক )

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

ঘুরে এলাম মায়ানমার ।

 বৃহস্পতি বার রাতের এগারটায় হঠাৎ আমার মেজ কুটুম ( শালা ) ফোন করল

ঃ দুলাভাই বার্মা যাবেন নাকি ?

উল্লেখ্য আমার মেজ কুটুম গত তিন বছর যাবৎ টেকনাফে দোকান নিয়ে মায়ানমারের সাথে ব্যাবসা করছে ।

ওর এই প্রস্তাবে আমিও উৎফুল্ল হয়ে গেলাম । তারপরও নিজের ব্যাবসার কথা চিন্তা করে আবার মিইয়ে গেলাম । তারপরও বললামঃ কখন যাবে ?

ঃ কালকে শুক্রবার ।

ঃঠিক আছে । কালকে গেলে তোমাকে ফোন করব।

ঃ কালকে গেলে সকালে আমাদের বাড়িতে চলে আসবেন । এখান থেকে জুম্মার নামায পড়ে রওয়ানা দেব।

ঃআছ্ছা ।

শুক্রবার দিন সাধের ঘুম জলান্জলী দিয়ে সকাল আট টা বাজে উঠে গেলাম । গোসল আর নাস্তা করতে করতে প্রায় নয়টা বেজে গেল । তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হলাম। বাসার সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে নিউমার্কেটের মোড়ে গেলাম । সেখান থেকে টেম্পোতে করে নতুন ব্রীজ পৌছলাম।



নতুন ব্রিজ।

এখান থেকে যেতে হবে সাতকানিয়া । । ভাল কোন গাড়ি পাছ্ছিনা । ভাল গাড়ি বলতে এস আলম , সৌদিয়া , শাহ আমিন । এরা অন্য দিন সাতকানিয়া আমিরাবাদের লোকদের জামাই আদর করে গাড়িতে তুলে । শুক্রবার হলে তারা আমাদের ( সাতকানিয়া ও আমিরাবাদি ) চিনেই না । কক্সবাজার যেতে যে সাতকানিয়া, আমিরাবাদ বলে কোন জায়গা আছে ওরা যেন ভুলেই যায় । নতুন ব্রীজ থেকে সাতকানিয়ার স্বাভাবিক ভাড়া ৬০ টাকা । আজ শুক্রবার, তাই ভাড়া ১০০ টাকা । এই হল আমাদের সোনার বাংলাদেশ ।কোন আইন নাই, কানুন নাই । যার যেমন ইছ্ছা ভাড়া বাড়িয়ে ফেলে । প্রশাসন আছে কিন্তু তাদের এই সব দেখার সময় নাই । তারা সরকারের গদি সামলাবে না এই সব দেখবে ?

প্রশাসন এখন ক্ষমতাশীন রাজনীতিকদের সেবক । সাধারন জনগনের সেবা করার সময় কোথায় ?

যাই হোক একটা লোকাল গাড়িতে উঠালাম । এই গাড়িই অন্যান্য দিন লোকাল ভাড়ায় চলে । আজ জাতে উঠেছে, তাই স্পেশাল সার্ভিস হয়েছে। কনট্রাক্টর আর হেলপারের যে ভাব, মনে হয় গাড়ি নয় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনের ক্রু ।

গাড়িতে উঠলাম । বসে আছি । গাড়ি এখনও ছাড়েনি আসন পূর্ন করে যাত্রী সব নেওয়া হলে, তারপর বাস ছাড়বে । প্রায় পৌনে এগারটার দিকে বাস ছাড়ল ।

এই সময় মেজ কুটুম ফোন করলঃ কোথায় ?

ঃবাসে ।

ঃ ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়েছেন?

ঃ নাত ! কেন?

ঃ মায়ানমার যেতে হলে মায়ানমারের পাসপোর্ট বানাতে হবে । তখন ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি লাগবে ।

আমি কিছুক্ষন চিন্তা করে বললাম অসুবিধা নাই বন্দোবস্ত হবে যাবে ।

এরপর যোগাযোগ বিছ্ছিন্ন করে দিলাম ।

তারপর বাসায় ফোন করলাম । আমার বেগমকে বললামঃ দেখোতো বাসায় আমার ভোটার আইডি কার্ডটা আছে কিনা ?

সে খুজে পেলানা ।

বুঝলাম বাসায় নাই । ছোট ভাইকে ফোন করলাম । বললামঃ আমার দোকানের দেরাজের ভিতর ভোটার আইডি কার্ডটা আছে । তুই ওটা নিয়ে আমার ই-মেইলে পাঠিয়ে দে।

জুম্মার আযানের আধা ঘন্টা আগে কেরানী হাট নামলাম ।



কেরানি হাট।

ওখান হতে সিএনজি করে আনুফকিরের দোকানে নামলাম । ততক্ষনে আযানের সময় হয়ে গেছে । এস্তেনজা ( টয়লেট ) ও অজু করে আনুফকীরের দোকানের মসজিদে জুম্মার নামায আদায় করলাম।

ওখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে আমায় জান্নাতবাসি মায়ের কবর। আহ ! কি মায়া মাখা ছায়া ঢাকা সেই কবর। চারদিকে সুপারী গাছের ঘেরা । সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো শান্ত নিবির পরিবেশে শুয়ে আছে আমার জান্নাতবাসি মা । সেখানে যেয়ে জিয়ারত করলাম ।

জান্নাতবাসি মায়ের কবর জিয়ারত করে সোজা শ্বশুর বাড়ি চলে এলাম। সেখানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিলাম। শ্বশুর বাড়ির খাওয়াত ! এমন ভূড়ি ভোজনের পর বিশ্রাম না নিয়ে কি পারা যায় ?

তারপর আমি আর মেজ কুটুম বের হয়ে সোজা আমিরাবাদ। ওখানে আছরের নামায পড়ে , টেকনাফের উদ্দেশে বাসে উঠার জন্য বাস কাউন্টারে গেলাম । বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম ভীষন ভীড় । শুক্রবার দিন বিকালে সবাই ফেরার জন্য হুড়োহুড়ি করছে । কারন শনিবার সকাল থেকে কর্মক্ষেত্র যেতে হবে । আমার মেজ কুটুম বহু কষ্টে সৌদিয়া বাসের দুটি টিকিট যোগাড় করল । আমরা মাগরীবের আগে আগে গাড়িতে উঠলাম ।

গাড়ি চলতে লাগল টেকনাফ লিংক রোডের উদ্দেশে । গাড়ি যখন চকোরিয়ার কাছাকাছি তখন মাগরীবের নামাযের সময় গেল। ভাবলাম নামযের জন্য গাড়ী দাড়াবে তাই একটু আপেক্ষা করলাম । নাহ ! গাড়ি থামল না । তখন সিটের উপর নামায পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । মেজ কুটুমকে বললাম তুমি উঠে দাড়াও আমি নামাযটা পড়ে নিই । ও উঠে দাড়ালে আমি নামায পড়ে নিলাম । আমার নামায পড়া দেখে ড্রাইভার মেজ কুটুমকে বললঃ আপনারা নামায পড়বেন বললেন না কেন ? বললেইত আমি গাড়ি থামাতাম।

ও কোন উত্তর দিল না ।

আমি নামায পড়ার পর মেজ কুটুম পড়ল।

ভাবতে অবাক লাগে !! বাংলাদেশ ৮০% মুসলমানের দেশ। সেই দেশে একটি বাসের চল্লিশ জন হতে পাচচল্লিশ জন মানুষের মধ্যে আমরা মাত্র দুইজন মানুষ নামায পড়লাম । তাহলে আর সবাই কি বিধর্মী...........। এই যদি হয় অবস্থা ! তবে এই দেশে নাস্তিকদের আস্ফালন বাড়বে না কেন ?

এশার নামাযের আগে আমরা কক্সবাজার হতে অনেকটা আগে লিংক রোডে নামলাম । ওখানে নেমে একটা হোটেলে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে নিলাম । তারপর ভূনা গরুর গোশত আর ছেকা ( কম তেলে ভাজা ) পরাটা দিয়ে নাস্তা করলাম । খাওয়া দাওয়ার পর টেকনাফগামী গাড়িতে উঠলাম । প্রায় রাত সাড়ে দশটার দিকে টেকনাফ পৌছলাম .......।



ঘুরে এলাম মায়ানমার। ( এক )

তারপর দিন সকালে যখন ঘুম ভাংগল মেজ কুটুম বললঃ তাড়াতাড়ি উঠুন । আজকে শনিবার তাই তাড়াতাড়ি এই রুম খালি করতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললামঃ কেন ?

ঃ এই রুমের ভাড়া আমরা দুইজনে দেই । একজন আমি, আরেকজন ইন্সুরেন্স কোম্পানির লোক। আড়াই হাজার টাকা ভাড়ার মধ্যে ওই লোক দেয় দেড় হাজার আমি দেই এক হাজার । আমরা ব্যাবহার করি সারা সপ্তাহ আর ওই লোক করে শুধু শনিবার সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা ।

এই কথা শুনে কি দেরি করা যায় !! তাড়াতাড়ি উঠে মুখ হাত ধুয়ে বের হয়ে গেলাম । হাটতে হাটতে বেশ কিছুটা এগিয়ে ভাল একটা হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম ।

সেখানে পরাটা আর মুগ ডাল দিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে এক কাপ চা পান করে হোটেল থেকে বের হলাম। মেজ কুটুমকে বললামঃ এবার কাজ কি ?

ঃ এবার আপনার দুই কপি ফটো তুলতা হবে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ আরেক কপি স্টাম্প সাইজ , আর আপনার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি করতে হবে ।

ঃ তাহলে এক কাজ কর। আমাকে কোন সাইবার ক্যাফেতে নিয়ে যাও ।

তারপর আমরা দুইজনে টেকনাফে সাইবার ক্যাফে খুজতে বের হলাম । অনেকক্ষন খুজেও কোন সাইবার ক্যাফে পেলাম না। হাটতে হাটতে কাচা বাজারের কাছে চলে এলাম । কাচা বাজারে টাটকা মাছ আর সবজী দেখে সাইবার ক্যাফের কথা ভুলে গেলাম ।



মেজ কুটুমকে বললামঃ এখানে মাছের দাম বোধহয় কম তাই না ?

ও দুইচোখ কপালে তুলে বললঃ কম দা-ম !!!! কি যে বলেন না, বরং শহরের চেয়ে দাম বেশি ।

আমি অবাক হয়ে বললামঃ বল কি !! কেন এখানে নদী সমুদ্র দুইটাইত কাছে তারপরও এত দাম ?



ঃ এখানকার মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এত বেশি যে কোন জিনিসের দাম যতই বেশি হোক ওরা কিনতে ভয় পায় না ।

ঃ এত টাকা পায় কই ?

ঃ কেন ডব্লিউ আর লবন।

ঃ ডব্লিউ এটা আবার কি ?



ইয়াবা ।

ঃ ইয়াবা । এখানে উচ্চ হতে সাধারন জনগন প্রায় সবাই কম বেশি ডব্লিউ ব্যাবসার সাথে জড়িত । এছাড়া আরও অন্যান্য ব্যাবসাত আছেই। কানাঘুষায় শুনি টেকনাফের বর্তমান এম পি বদি এই ডব্লিউ ব্যাবসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সে এই ব্যাবসা করার জন্য প্রশাসন, আওয়ামীলীগ , বি এন পি , জামাতের প্রায় সব নেতাকে সাথে নিয়েছে । এই ব্যাপারটা এখানে ওপেন সিক্রেট ।

এখানকার প্রত্যেক যুবক আলীশান ভাবে জীবন যাপন করে । তাই এখানে দামি দামি মোটর সাইকেলের এত ছড়াছড়ি । এখানে সবাই এক । তাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাই বললেই চলে । এই জন্য টেকনাফে ইয়াবার কোন চালান ধরা খায়না বললেই চলে । ইয়াবার চালান যা ধরা খায় সব টেকনাফের বাইরে । সত্য মিথ্যা আল্লাহই ভাল জানেন। এই টেকনাফে এমপি বদির কথাই শেষ কথা । একবার এক বি ডি আর তাকে না চিনে তার গাড়ি থামিয়ে ছিল বলে । এম পি বদি গাড়ি থেকে নেমে সেই বি, ডি, আরকে সজোরে এক থাপ্পর মেরেছিল । এই কথা বদির সমর্থকরা গর্ব করে সবাইকে বলে।

ঃ আমি শুনে " থ " !!!

ভাবতে লাগলাম যেই দেশের জননেতা সেই দেশের যুব সম্প্রদায় অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নেতৃত্ব দান কারী প্রজন্মকে ধ্বংস করার নেশার দ্রব্য আমদানী করে , সেই দেশের ভবিষ্যত যে কতটুকু অন্ধকার তা ভেবে শিউরে উঠলাম। আর এদেরকেই আমরা ভোট দেই । অবশ্য এরা আমাদের ভোটের থোরাই কেয়ার করে । নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নিজেরাই ভোট আদায় করে নেয়।

মনে হল এই দেশে জন্মই আমার আজন্মের পাপ।

আমাকে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মেজ কুটুম বললঃ কি হল দাড়িয়ে গেলেন যে ?

আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাটতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর মেজ কুটুম আবার বললঃ বেশ কিছুদিন আগে টেকনাফে প্রধান মন্ত্রি এসেছিল। তখন জনসভায় এমপি বদি জনতাদের উদ্দেশে বলেছিলঃ আপনারা কে কে আগামীতে আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চান তারা হাত তুলুন ।

অবাক কান্ড হাজার হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র শখানেক হাত উঠেছিল ।

এই ব্যাপারে পরে এমপি বদিকে জিগ্গাসা করা হলে সে বলেছিলঃ আমার কথা সব জনতা বুঝতে পারেনি ।

যাই হোক আবার সাইবার ক্যাফে খুজতে লাগলাম। পেলাম না । তখন আমি বললামঃ চল আগে ছবিটা তুলে ফেলি, তারপর ঐ ফটোর দোকানে জিগ্গাসা করলে হয়ত জানতে পারব কোথায় সাইবার ক্যাফে আছে ?

হাটতে হাটতে একটা ফটোর দোকানে ঢুকলাম। বললাম ফটো তুলব । আপনারা কি ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটো তুলেন ?

ওরা বললঃ হ্যাঁ ।

আমি বসে গেলাম । একটা ছেলে ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটো তুলল ।

ফটো তুলার পর একটা ল্যাপটপে ঢুকাল । দোকানের মালিক কম বয়সি একটা ছেলে। দেখলাম সে ছবিটা এডিট করে একটা পাসপোর্ট সাইজ একটা স্টাম্প সাইজ করে দুইকপি করে চার কপি প্রিন্ট আউট করল। এই সময় আমি দেখলাম ওর ল্যাপটপে ইন্টারনেট মডেম লাগানো।

ঃ আপনার কি ইন্টারনেট কানেকশান আছে ?

সে হ্যাঁ বলতেই বললামঃ আমার ই-মেইল থেকে আমার ভোটার আইডি কার্ডটা প্রিন্ট আউট করে দেন।

ছেলেটা জিমেইলে যেয়ে আমাকে দিয়ে মেইলটা খুলে নিয়ে ডাউনলোড করে নিল। ওর ল্যাপটপে ডাউনলোড হওয়ার পর প্রিন্ট আউট করল। তারপর একটা ফটো কপি করলাম। কাজ শেষ হলে জিগ্গাসা করলামঃ কত দেব ?

ঃ আশি টাকা দেন ।

টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হলাম ।

এইবার মেজ কুটুম বললঃ আপনার কাছে যত টাকা আছে সব, আর মোবাইল দুইটা দিন ।

ঃআমি অবাক হয়ে বললামঃ কি ব্যাপার ছিনতাই কারী হয়ে গেলে নাকি ?

ও হাসতে হাসতে বললঃ না ওগুলো নিয়ে মায়ানমার যাওয়া যাবে না, তাই দোকানের ছেলেকে আসতে বলেছি এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য । আপনার দরকারি নাম্বারগুলো কাগজে লিখে নিন । মায়ানমার থেকে তাহলে ফোনে কথা বলতে পারবেন।

তারপর সে আমাকে নিয়ে একটা দোকানে গেল । দোকানটা বোধহয় পূর্ব পরিচিত । ওখানে একজন থেকে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে, আমাকে দিল বললঃ নাম্বারগুলো লিখে নিন ।

আমি দাড়িয়ে কাউন্টারের উপর কাগজ রেখে নাম্বারগুলো লিখতে লাগলাম। এইসময় ময়লা বোরকা পরা একজন মহিলা প্রবেশ করল । বয়স ত্রিশের কম বেশি হবে । সে দোকানের ছেলেটার কাছে দাড়িয়ে এক ধরনের উচ্চারনে চিটাগাং এর ভাষায় কথা বলছিল । পরে জেনেছি ওটা রোহিংগা ভাষা । সে ছেলেটি কে বললঃ কেমন আছ ?

ঃ ভালআছি ।

ঃ আমার টাকাটা দাও ।

ঃ কিসের টাকা ?

ঃ কেন মালের বাকি একশ আশি টাকা ।

ঃ না দেব না ।

ঃ কেন দিবা না । আমি গরিব মানুষ এই একশ আশি টাকা দিলে বাজার করব । তারপর রান্না করে খাব।

আমি মেজকুটুমকে আস্তে করে জিগ্গাসা করলাম মেয়েটি কে ?

ঃ রোহিংগা । বার্মা থেকে দুই চার হাজার টাকার মাল বৈধ পথে টেকনাফে এনে বিক্রি করে ।

ছেলেটি মহিলাটির কথার প্রতিউত্তরে বললঃ এই টাকার জন্য তুমি মরে যাবা ?

ঃ তুমি জান ? আজকে সকালে আধাপেট ভাত খেয়ে বের হয়েছি । বাচ্চাদেরও পেট ভরে খাওয়াতে পারিনি।

আমি আর শুনতে পারলাম না । মেজ কুটুমকে নিয়ে আস্তে করে দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম । ঐ মেয়েটি যদি ভিক্ষুক হত তাহলে কিছু টাকা দিয়ে নিজেকে হালকা করতাম ।



কিন্তু মহিলাটিত তা নয় , সেত খেটে খাওয়া আত্মনির্ভরশীল একজন নারী। যে নারী জীবন যুদ্ধে মরতে জানে, পরাজয় বরন করতে জানেনা । তাকে শ্রদ্ধা করা যায় তার জীবনার্দশ অনুসরন করা যায় । এমন নারীকে ভিক্ষা দেওয়া যায় না। 


দোকানের ছেলেটা এল। ওর হাতে সব কিছু দিয়ে আমি আর মেজ কুটুম টেকনাফ বাস স্ট্যান্ডের দিকে চলে এলাম। এখানে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম । সিএনজি চলতে শুরু করল। টেকনাফ শহর ছেড়ে সিএনজি চলতে চলতে পিচ ঢালা পথ বেয়ে উচু দিকে উঠতে লাগল ।



এই রাস্তাটা পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। সিএনজি উঠতে উঠতে যখন উপরের সমতলে চলে এল তখন প্রকৃতির রুপের ছটায় আমার ভ্রমন ক্লান্ত মনটা মুগ্ধ হয়ে গেল। অন্তরের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে এলঃ আলহামদুল্লিলাহ !! হে আল্লাহ কত সুন্দর আমার জন্মভূমি ! তুমি আমায় এই দেশে জন্ম দিয়েছ তাই আমি ধন্য।



ওখান থেকে দেখা যায়, পাহাড় হতে যেন সবুজের গালিচা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে নাফ নদীর রুপালি তটে । নদীর রুপালি তটও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে নদীর নীলাভ ঢেউয়ের বুকে । সেখানে বাতাস আর ঢেউয়ের কত অজানা কানাকানি । নদীর পাড়ের কাছাকাছি ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে।



নাফের ঐ পাড়ে মায়ানমার সীমান্তে গাঢ় সবুজ পাহাড় যা দেখতে অনেকটা কালচে রং এর মনে হয় । বিশাল উচু উচু সব পাহাড়। দেখে মনে হয় একজন আরেকজনের কাধেঁ হাত রেখে দাড়িয়ে টেকনাফের পাহাড় গুলোর সাথে আড্ডা মারছে । মাথায় তাদের ছাই রংয়ের মেঘের টুপি । হয়ত সেই টুপি থেকে ঝরঝর বৃষ্টি হছ্ছে । এতদুর থেকে দেখা যাছ্ছে না।



সোজা বন্দরে চলে এলাম । সিএনজি থেকে বন্দরের দিকে প্রবেশ করতেই গেটের ভিতরে একটা ওয়াচ ঘর । সেখানে পাচজন বর্ডার গার্ড বসে আছে । তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, দুইজন তরুনী । পুরুষরা আগতদের সাথে কথা বলছে তথ্য লিখছে । তরুনীদ্বয় বর্ডার গার্ডের পোষাক পড়ে শোভা বর্ধন করছে অর্থাৎ বসে আছে। মেজ কুটুম ওর পাসপোর্ট দিল। বর্ডার গার্ডরা পাসপোর্ট থেকে তথ্য লিপিবদ্ধ করে নিল। মেজ কুটুম এবার আমার ভোটার আইডি কার্ড ও ছবিগুলো দিল । ওরা বললঃ নতুন?

ঃহ্যাঁ ।

আমার দিকে তাকাল তারপর তথ্যগুলো লিখে আমাকে জিগ্গাসা করলঃ বাড়ি কোথায় ?

বললাম।

ঃ নাম কি ?

ঃ বললাম।

এরপর আর কিছু জিগ্গাসা করল না । আমার জন্য নতুন পাসপোর্টের বই দিয়ে দিল। বইটা এখনও পাসপোর্ট হয়নি। এবার আরও সত্তর গজের মত ভিতরে গেলাম। হাটতে হাটতে মেজকুটুম বললঃ আপনার ভাগ্য ভাল মাঝে মাঝে এখানে এমন কতগুলো বসে , অসম্ভব কর্কশ ভাষী ।

আমি মুখে কিছু বললাম না । মনে মনে বললাম সীমান্ত প্রহরীদের ব্যাপারে হযরত ইব্রাহীম আলাইহী ওয়াসাল্লামও মন্তব্য করেছেন । কারণ বিবি সায়রাকে নিয়ে তিনি যখন মিশর সীমান্ত পার হছ্ছিলেন তখন এই সীমান্ত প্রহরীরা উনাকে বিপদে ফেলেছিল ।

এখানে একটা বিল্ডিং দুই তলা । প্রবেশ করলাম । ভিতরে তিনজন লোক বসা । মেজ কুটুম একজনকে কাগজ পত্র সব দিল । যাকে দিল দেখলাম সে মেজকুটুমের সাথে খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলছে। এমনকি নাম ধরেও ডাকছে । বুঝতে পারলাম এখানে মেজ কুটুমের সাথে সবার সম্পর্কটা ভাল । লোকটি বলল ঃ ইনি তোমার কে হন ?

ঃ আমার বড় বোনের স্বামি।

শুনে লোকটা উৎফুল্ল হয়ে বললঃ দুলাভাই !!

আমাকে জিগ্গাসা করলঃ কি দুলাভাই বেড়াতে যাবেন ?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

যাই হোক এখানে দ্রুত সব কিছু হছ্ছিল । পাসপোর্ট বাবদ এক হাজার টাকা জমা দিতে হল। এই পাসপোর্টের মেয়াদ এক বৎসর । এখান থেকে মায়ানমারের ভিসা দিবে সাত দিনের । এই ভিসা নিয়ে মায়ানমার গেলে মায়ানমার সরকার ভিসা দিবে মাত্র তিন দিনের ।

এরপর আমার আর মেজ কুটুমের ছবি কম্পিউটারে তুলে নিল।

মেজ কুটুম বললঃ আগেত ছবি নিতেন না ।

ঃ একটু ঝামেলা হয়েছে তাই নতুন নিয়ম করেছে।

যাই হোক আমার অপূর্ব সুন্দর মায়াবী (??! ) চেহারা খানা ওদের কম্পিউটারের মেমোরিতে রেখে আমরা ঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম । ঘাটে পৌছার আগেই বিল্ডিং এর পিছনের গেটের সামনে এক লোক টিকিট হাতে দাড়িয়ে আছে মেজকুটুম ওর কাছ থেকে দুইটা টিকিট নিল।

মেজ কুটুম বললঃ মায়ানমার যেতে একবারই টিকিট কাটতে হয় । এটাই আসা-যাওয়ার টিকেট। একটু তাড়াতাড়ি হাটেন । বোট বোধহয় ছেড়ে দিছ্ছে ।

আমরা দ্রুত পদক্ষেপে প্রায় দুইশ গজ পরে বোটের সামনে এসে দাড়ালাম। এখানে আরেকজন লোক আমাদের টিকেটের একটু করা অংশ ছিড়ে নিয়ে নিল।

আমি বোট দেখে মুগ্ধ !! আমি আগে ও দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়েছি। তখন গিয়েছি ওমান এয়ার লাইন্সে এসেছি গালফ এয়ারে । আহ !! কি আরামের ভ্রমন ! কিন্ত এখানে !!! বিদেশ যাওয়ার একি বাহন !! যাব না পালাব ভাবছি ।



এই সময় মেজ কুটুম বললঃ কি হল উঠুন । বোট ছেড়ে দিছ্ছেত ।

ওর কথার তাগাদায় আমি চমকে কখন যে নাফ ওয়াটার ওয়েজে উঠে গেছি নিজেই জানিনা। উঠে কাঠের পাটাতনে বসলাম । আমি একটু মোটাসোটা মানুষ । ওজন ৭৬ কেজি । তাই বসতে একটু কষ্ট হছ্ছিল । মেজ কুটুম আমার আশেপাশে জায়গা পেলনা তাই একটু দুরে বসল।

এই বোট দিয়ে মানুষ টানে আবার মালও টানে । বোটের মধ্যেখানে খোলের মত আছে । মাল টানার সময় সেখানে মাল নেয় । মানুষ পারাপাড়ের সময় নারী ও শিশুদের ওখানে বসানো হয়। আমি যেখানে বসেছি তার সামনে বোটের ইন্জিন । ইন্জিন হতে প্রায় চার-পাচঁ হাত দুরে , আমার পিছনে বোটের সারেং দাড়ায় । অর্থাৎ যার হাতে বোটের হাল থাকে । বোটটাকে মুলত সেই চালায় । ইন্জিনের কাছে ছোট্ট একটা ছেলে বসে থাকে । বয়স এগার হতে তের বছর হবে । ছেলেটির কাজ হল ইন্জিন স্টার্ট দেওয়া , গিয়ার বদলানো, বোটের গতি বাড়ানো কমানো আর বোটের খোলের ভিতর পানি জমলে সেই পানি তুলে নিয়ে নদী তে ফেলা ।

বোট ছিল নারী-পুরুষ আর দুইটি শিশুতে ভর্তি । বোট ছেড়ে দিল । আমারও বারটা বাজা শুরু হল। ইন্জিনের এমন ভটভটি আওয়াজ আমার কানের পর্দা যায় যায় অবস্থা। বোটটা এমন ভাবে মানুষে ভর্তি যে নড়াচড়ারও জায়গা নাই । কি আর করা কোন প্রকারে সহ্য করে থাকতে হল। 
 

আকাশটা মেঘলা তাই রোদের তাপ নাই। নদীর বাতাস একটু গরম। মাঝে মাঝে হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হছ্ছে। বোট দ্রুত গতিতে মাঝ নদীতে প্রবেশ করল । টেকনাফ অনেকটা পিছনে চলে গেছে ।

আমি আকাশের দিকে তাকালাম । সামনে একটা ঘন কালো মেঘের আস্তর দেখে মনে মনে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে, মেজ কুটুমকে জিগ্গাসা করলাম ঃ ছাতি এনেছ ?

ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বললঃ না আনিনি । আপনি চিন্তা করবেন না বৃষ্টি পড়লে ছাতির ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

ওর কথায় আশ্বস্থ হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। বোট এগিয়ে চলছে। আমি কতক্ষন নদীর ঢেউ গুনি কতক্ষন খোলের ভিতর এক বোরকা পড়া এক সুন্দরী মেয়ের কান্ড কারখানা দেখি। সুন্দরী মেয়েদের বয়স আন্দাজ করা কঠিন তাই ঐ কঠিন অংকে গেলাম না । পাঠক-পাঠিকারা যার যার মত বয়সটা কস্ট করে ধরে নিবেন । যদিও আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

মেয়েটি তার সামনে বসা চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে খুটসুটি করছিল । সুন্দরীর আর বাচ্চা মেয়েটির খুনসুটি বোটের সবাই মিলে উপভোগ করছি আর মায়ানমারের দিকে এগিয়ে চলছি । যদিও বোটের মুখ এখন পর্যন্ত সমুদ্রের দিকে, তাই বাম পাশে মায়ানমার এখনও আনেকটা দুরে ।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর আমারা বৃষ্টির কবলে পরলাম । হঠাৎ ভারী বর্ষনে ছাতি নিতে নিতে আমরা বোটের সবাই অর্ধেক ভিজে গেছি। মেজ কুটুম তার ব্যাবসায়িক বন্ধুর ব্যাগ হতে একটা সুন্দর লেডিস ছাতি বের করে দিল। ছাতি ওয়ালা বেচারা মনে হয় ছাতি খানা স্যাম্পল হিসেবে মায়ানমার নিয়ে যাছ্ছিল । ছাতি পয়ে মোটামোটি বৃষ্টির হাত থেকে আমি সহ কয়েকজন রক্ষা পেলেও মেজ কুটুমসহ বেশির ভাগ যাত্রীই ভিজে গেল। ছয়-সাত মিনিট পরই বৃষ্টি চলে গেল । এরপরই এমন রোদ উঠল যে ছাতি আবার খুলতে হল।

প্রায় দেড়ঘন্টা পর হঠাৎ বোট তার মুখ ঘুরিয়ে বামে মোড় নিল । এবার আমাদের বোটটি বড় নাফ নদী ছেড়ে ছোট একটা খালে প্রবেশ করল । খালে প্রবেশ করা মাত্র আমরা মায়ানমার সীমান্তে ঢুকে গেলাম । খালের দুই পাশে তাকালাম। বোটের ডান দিকে অর্থাৎ সুমদ্রের দিকে একটু খানি এলাকা । ঐ এলাকা পুরাটাই প্রায় পনের ফুট উচু কাটা তার দিয়ে ঘেরা । বেশ কিছুদিন আগে মায়ানমারে যে সাম্প্রদায়ীক দাংগা হয়েছিল, তখন মুসলমান রোহিংগা যারা আকিয়াব ( মায়ানমারের সীমান্ত প্রদেশ । সীমান্ত থেকে প্রায় তিন মাইল দুরে । ) থেকে নৌকা করে পালিয়ে এসেছিল তারা যেন আবার মায়ানমারে ঢুকতে না পারে তাই এই ব্যাবস্থা । দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। না জানি কত অসহায় মুসলমান ভাই বোনেরা সারারাত ঐ কাটা তার ধরে দাড়িয়েছিল আর দুই চোখের নোনা জল ফেলে কতই না কাকুতি মিনতি করেছিল মগাদের কাছে একটু আশ্রয় আর খাবার পানি পাওয়ার আশায়। বাংলাদেশেও তারা আশ্রয় চেয়েছিল । আমাদের পাষান হৃদয় তাদের আশ্রয় দিতে পারিনি । আমরা দিতে না পারলেও দয়ালু নাফ নদী তার বুকে অনেককেই আশ্রয় দিয়েছে। জানি না কাল কেয়ামতের মাঠে কি জবাব দেব মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তালার কাছে।

বাম দিকে তাকালাম দেখলাম বিশাল প্রান্তরে শুধু একটা সেমিপাকা ঘর তার পাশে বৌদ্ধদের উপসনালয়।



সোনালী রংয়ের ছটায় জ্বলজ্বল করছে । দেখে মনে হয় এইমাত্র রং করেছে।

আস্তে আস্তে বোট মায়ানমার বন্দরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল । খালের মুখ হত মায়ানমার প্রায় তিন-চারশ গজ দুরে হবে। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বোট মায়ানমার বন্দরে ভিড়ল । আমারা সবাই নামলাম। বন্দরে সব মগা জাতির লোক । তাদের পরনে বেশির ভাগেরই স্যান্ডো গেন্জি । আমি আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। এই সময় বন্দরের এক মগা অফিসার ইশারায় আমার মাথা টুপিটা খুলে ফেলতে বলল । প্রথম ধাক্কাটা খেলাম এখানে । এক প্রকার অপমানিত বোধ করে টুপিটা খুলে ফেললাম । যেই দেশে যেই নিয়ম । মানতেত হব । সেই সাথে মনে মনে শপথ করে ফেললাম জীবনে যদি বেচে থাকি এই দেশে আর আসব না।

ওখানে এক মধ্যে বয়স্ক এক অফিসার আছে সে আমাদের দাড়িয়ে থাকতে দেখে বসতে বলল। তার সাথে পানের কৌটা ছিল সেখান থেকে আমাদের পান খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। আমি সবিনয়ে উনার মেহমানদারী প্রত্যাখ্যান করলাম। এখানে সবাই প্রচুর পান খায় । একটার পর একটা পান মুখে দেয় । পানের সাথে প্রচুর পরিমানে চুন খায় । মেজ কুটুমকে জিগ্গাসা করলামঃ ওরা যে এত চুন খায় ওদের জিহ্বা পুড়ে যায় না ?

ঃ না ওদের জিহ্বা পুরে না। ওরা চুনের মধ্যে কি যেন মিশ্রিত করে চুনটা এক ধরনের মিষ্টি হয়ে যায়।

বন্দর অফিসাররা আমাদের পাসপোর্ট ভিসা চেক করল। তারপর জিগ্গাসা করল কোন হোটেলে উঠব?

মেজ কুটুম হোটেলের নাম বলল। আমি অবাক হয়ে মেজ কুটুমের দিকে তাকাতেই সে বললঃ এখানে কোন মেহমান বা বিদেশি এখানকার কোন স্থানিয়দের বাসায় রাত্রি যাপন করতে পারেনা। অতিথিদের রাতে হোটেলে থাকতে হয় । আর এখানকার ভিসা তিনদিনের । তিনদিনের ভিতর আপনি যদি ফেরৎ না যান তাহলে এখানকার নাসাকা বাহিনী আপনাকে হোটেল থেকে খুজে এনে বোটে তুলে দিবে ।

এখানকার কাজ শেষ । আমরা এগিয়ে গেলাম সেখানে লম্বা একটা কামরায় প্রবেশ করলাম । এখানে আমাদের ফটো তোলা হবে। আমরা প্রবেশ করতেই দেখি সেই সুন্দরী মেয়েটির ভাই উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে। আর সেই মেয়েটি মেয়েদের চেক করার ছোট্ট একটি রুমের দরজায় দাড়িয়ে হাসছে।

মায়ানমারের এক মগা মহিলা অফিসার । তার পরনে সাঃা ফুল হাতা জামা আর কালচে সবুজ রংয়ের থামি ( লুংগীর মত ।)। মগা মহিলাটি মেয়েদের দেহ চেক করে। সে দোভাষীকে উত্তেজিত ভাবে কি যেন বলছে। দোভাষি যখন অনুবাদ করে মেয়েটির ভাইকে বোঝাছ্ছিল তখন বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কি ?

দেহ তল্লাশী করার জন্য যখন মায়ানমারের মহিলা সুন্দরী মেয়েটিকে রুমে নিয়ে যাছ্ছিল, তখন তার ভাই বাধা দিয়েছিল। ভাইটির বাধা দেওয়াটা কিছু বাড়াবাড়ি ধরনের হওয়াতে, মায়ানমারের মহিলাটি ক্ষেপে গিয়েছে। মায়ানমারের মহিলা দোভাষীকে বললঃ যে দেশের যে নিয়ম তা পর্যটকদের মানতে হবে। তানা হলে সেই দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না ।

দোভাষী কথাটা অনুবাদ করে ছেলেটিকে বলল। ছেলেটির বড় বোনের স্বামি ওদের সাথে ছিল । সে ছেলেটিকে ধমক দিয়ে মায়ানমারের মহিলার কাছে ক্ষমা চাইল । তারপর সব কিছু স্বাভাবিক হলে এল । আমি মনে মনে ভাবলাম এইসব মূর্খদের কে বলেছে এখানে আসতে ।

আমারা ওখান থেকে বের হওয়ার পর মেজ কুটুম বললঃ মাথায় টুপিটা দিয়ে দেন । আর হোটেলে যাওয়ার জন্য রিক্সা নেব না হেটে যাবেন ?

আমি বললামঃ এখানে রিক্সা কোথায় ?

মেজকুটুম হাসতে হাসতে বললঃ এই আপনার পাশেই দাড়িয়ে আছে ।

আমার দুই ঠোট ফাক হয়ে মুখে মাছি ঢোকার রাস্তা হয়ে গেল।

আমাদের দেশের বাই সাইকেলের পিছনের চাক্কার পাশে একটা গদির ফ্রেম করে তার সাথে আরেকটা চাক্কা লাগিয়ে এই রিক্সা বানানো হয়েছে । এই রিক্সায় দুইজন প্যাসেন্জার বসে । তবে বসাটাও অদ্ভুত একই সিটে দুই দিকে মুখ করে পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসতে হয়। একজনের মুখ থাকে সাইকেলের সামনের দিকে আরেকজনের মুখ থাকে সাইকেলের পিছন দিকে।

আমি রিক্সা দেখে বললামঃ হোটেল কি বেশি দুরে নাকি ?

ঃ না , এইত কাছেই মোড়টা ঘুরলেই পরে হোটেল।

আমরা হাটতে হাটতে হোটেলের দিকে চলতে লাগলাম।



চারদিকে দেখছি গাছগাছালীতে ভরপুর । প্রশস্ত রাস্তা । চারদিক পরিষ্কার পরিছ্ছন্ন । তেমন মানুষ জন নাই । মায়ানমারের সীমান্ত শহর । নাম মোংডু । কত সুন্দর পরিকল্পিত ভাবে তৈরী না জানি রাজধানী কত সুন্দর ।

আমরা বাংগালীরা এই বাংলাদশে চার হাজার বছর ধরে আছি। আমরা বলতে গেলে প্রাচীন জাতিদের মধ্যে একটি । কিণ্তু আমরা এই চারহাজার বছরেও অন্যান্য জাতিদের মত পরিকল্পিত ভাবে নাগরীক কাঠামো গড়ে তুলতে পারলাম না । পারলাম না নিজেদের পরিস্কার পরিছ্ছন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে ।

কিছুক্ষন হাটতেই হোটলে পৌছে গেলাম । খুব সুন্দর সাজানো গোছানো পরিবেশ । নাম কাহন্নাহ । হোটেলের ম্যানেজারকে জিগ্গাসা করেছিলাম কাহন্নাহ অর্থ কি ? উনি বললেনঃ নদীর কিনারা ।

দোতালায় দুই বিছানার একটি কামরা নিলাম। সেখানে ব্যাগ রেখে । মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হয়ে গেলাম। সুন্দর রাস্তা এখানকার মানুষদের মুল পোষাক লুংগী আর সার্ট । পোষাকটা অদ্ভুত ভাবে পড়ে। লুংগির ভিতর শার্টটা ইন করে পড়ে। এখানে যে বাহনটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় । আমাদের দেশের ইয়ামাহা এট্টি ৮০ সি সি মটর সাইকেলের মত মটর সাইকেল । প্রচুর দেখা যায়। এখানে দামও কম । বাংলাদেশী টাকায় বিশ/ পচিশ হাজার টাকা।

আমদের আবাসিক হোটেলে কোন খাওয়া দাওয়া ব্যাবস্থা নাই । দুপুরের খাওয়ার জন্য বের হলাম। এখানে দুই রকমের হোটেল আছে। এক রকম রোহিংগাদের আরেক রকম মগাদের । উল্লেখ্য এখানে কোন বর্মি জাতি নাই সব মগা জাতি । এই কিছুদিন আগে যে দাংগা হয়েছিল তার আগে নাকি মগাদের কোন হোটল ও স্বর্ণের দোকান ছিল না । দাংগার পর ওরা নিজস্ব হোটেল ও স্বর্নের ব্যাবসা শুরু করে । মগাদের প্রত্যেক হোটেলে বিশাল বিশাল এল সিডি টিভি আছে আর মেয়েরাই হোটেল চালায়। রোহিংগাদের হোটেলে কোন টিভি নাই আর পুরুষরা হোটেল চালায়।

তবে খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে রোহিংগারা সেরা। এমনকি আমি বলব আমাদের দেশের ভাল ভাল হোটেলে ও এত ভাল স্বাদের এত উন্নত মানের খাদ্য পাওয়া যায় না । সব টাটকা এবং ভেজাল ছাড়া । গরু বলে মহীষের গোশত বেচে না । দেশী মুরগী বলে ফার্ম বেচে না। তবে দামটাও বেশি । বাংলাদেশের এক টাকা মায়ানমারের দশ টাকার সমান। সেই হিসেবে আমরা দুপুরের খাওয়া খেয়েছি ওদের টাকায় চার হাজার টাকা আমাদের দেশের চারশ টাকা। খাওয়া খুব ভালই হল। এখন নামায পড়তে হবে ।

মেজকুটুম বললঃ মসজিদ বাজারের দিকে । চলেন মসজিদে নামায পড়ে আমার বন্ধুর দোকনে আপনাকে বসিয়ে আমি একটু বাজার ঘুরে আসব।

আমরা হাটতে হাটতে মসজিদের সামনে আসলাম । মসজিদটা অনেক পুরানো । জরাজির্ণ অবস্থা । দেখলাম গেটে বিশাল তালা লাগানো।

মেজকুটুম বললঃ চলেন বন্ধুর দোকানে যাই ওখানে পিছনের গেট আছে, ওটা দিয়ে মসজিদে ঢুকে নামায পড়ব।

আমরা ওর রোহিংগা বন্ধুর দোকানে এলাম।



রোহিংগা বন্ধুটি আমায় চিনত , তাই আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আমার নাম ধরে ভাই ডেকে ক্যাশ থেকে উঠে এল ।

রোহিংগা চিটাইংগা ভাষায় বললঃ কেমন আছেন ?

ঃ ভাল ।

ঃ বাড়িতে সবাই কেমন আছে ?

ঃ ভাল।

আমি কথা বেশি না বলে তাড়াতাড়ি বললামঃ ভাই কি নামায পড়ব আপনাদের মসজিদের মূল ফটকেত তালা দেওয়া । পিছনে কোন দিক দিয়ে ঢোকা যায় বলে।

বন্ধুটি মুখখানা মলিন করে বললঃ নাসাকা এসে এইটাও বন্ধ করে দিয়েছে।

ঃ বলেন কি ? তাহলে নামায ......।

ঃ একটু বসেন দোকানের পিছনে চাচাত ভাইয়ের বাড়ি আছে ওখানে ব্যাবস্থা করছি। আগে ভাত খান। বাসা থেকে নিয়ে এসেছি।

ঃ না ভাই, ভাত খেয়ে এসেছি। আগে নামাজের ব্যাবস্থা করেন।

কিছুক্ষন পড়ে এক লোক এক বদনা পানি এনে দিল । অজু করলাম । তারপর একটা ঘরে নিয়ে গেল।



উচু পাটাতনের বাড়ি । সেখানে সামনের কামরায় জায়নামাজ বিছানো ছিল। দুই রাকাত যোহরের কছর নামায পড়লাম । কারন আমি মুসাফীর।

নামাজ পড়ার পর বসলাম। সবুজ রংগের মোসাম্বি নিয়ে এল। ওরা বলে লেমু । কেটে প্লেটে করে দিল। সাথে লবন। খেতে খেতে জিগ্গাসা করলামঃ কি ব্যাপার ভাই আপনাদের কি অবস্থা । মসজিদ বন্ধ কেন ?

ঃ ভাই আমাদের সেই দাংগা এখনও শেষ হয়নি। আজ তেইশ বছর কোন মসজিদে আযান দিতে পারি না । গতকাল পর্যন্ত নামাজ পড়েছি মসজিদে । আজ থেকে বন্ধ । জুম্মার নামায পড়তে পারি না । এতদিন যাবৎ পান্জেগানা নামায পড়েছি তবে, জোরে একামত দিয়ে জামাত পড়তে পারিনি। চার-পাচজন মিলে কয়েকবার করে জামাতে নামায আদায় করতাম। সন্ধ্যা ছয়টা বাজে বিদ্যুৎ দেয় রাতের দশটা বাজে আবার বন্ধ করে দেয় । রাতে বিদ্যুৎ যাওয়ার পর নাসাকারা বের হয় । মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশী চালানোর নামে ডাকাতি করে । মেয়েদের গায়ে হাত দেয় । প্রতিবাদ করলে ধরে নিয়ে যায় । তারপর দিন কোর্টে চালান করে দেয় । কোর্টে নেওয়ার সময় মেইন রোড দিয়ে না নিয়ে মগা পাড়া দিয়ে হাটিয়ে হাটিয়ে নিয়ে যায় । মগা পাড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মগারা মুসলমানদের অকথ্য ভাষায় গালাগালী করে আর দৈহিক নির্যাতন করে । এতে অনেকে গুরুতর আহত হয়ে যায় । আহত মুসলমানদের দেখে নাসাকা হাসে আর বন্দুকের ডাট দিয়ে মারতে বলে তাড়াতাড়ি চল। বাইরের বিদেশী কেউ বা জাতিসংঘের কেউ সরেজমিনে তদন্ত করতে আসলে। মগারা মুসলমানদের মারে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় । আর বলে তোরা খবর দিয়েছস তাই ওরা এসেছে। সুকি ওদের ভিতরে ভিতরে সাহস দেয় । উপরে আমাদের জন্য মায়া দরদ দেখায়। আসছে। এই বর্তমান সামরিক সরকার চলে গেলে আমাদের উপর অত্যাচার আরও বাড়বে । প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে মগারা একবার আমাদের উপর চড়াও হয়েছিল । তখন তিনি মায়ানমার সরকারকে বলেছিলেন দুই ঘন্টার ভিতর যদি মুসলমানদের উপর অত্যাচার বন্ধ না হয় তাহলে আমি টেকনাফ দিয়ে আর্মি ঢুকিয়ে দেব। তখন সাথে সাথে মায়ানমার সরকার মগাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিয়ে ছিল। ( আমি মনে মনে বললাম তখন মায়ানমারের চেয়ে বাংলাদশের সাথে চীনের সম্পর্ক ভাল ছিল।) এরপর অনেকদিন আমরা শান্তিতে ছিলাম । দোকানদারি করতে নানা খবরদারি । মগাদের সাথে বেশি কিছু বলা যায় না। এখানে আমাদের বাংগালী কোন স্কুল নাই । মগাদের স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতে হয়। স্কুলে আমাদের বাচ্ছাদের পড়ানো হয় না । মগাদের বাচ্চাদের পড়ানোর সময় আমাদের বাচ্চাদের আলাদা কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা নিজেরা ঘরে যতটুকু পারি বাচ্চাদের পড়াই । যত মাদ্রাসা ছিল সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোরান হাদিসের শিক্ষা এখন বন্ধ । আমরা ঘরে শুধু আরবী অক্ষরটা শিখাই । কোথাও এক জায়গায় বেশি লোক জমায়েত করতে হলে নাসাকা থেকে অর্ডার নিতে হয়। তখন ওরা ওখানে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়।

খুব কষ্টে আছি ভাই ।

ঃ আপনারা প্রতিরোধ করতে পারেন না ।

ঃ প্রতিরোধ করার জন্য ট্রেনিং নিতে হয় । সেই জন্য অন্য কোন দেশের সাহায্য লাগে । আমাদেরত কেউ সাহায্যও করে না জায়গাও দেয় না। প্রতিনিয়ত আমাদের মুসলমান বোনদের ওরা ধর্ষিত করছে । ধর্ষিতা বোনের দিকে তাকতে পারিনা । তিলে তিলে গড়া আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিছ্ছে । বল্লমের আগায় আমাদের শিশু সন্তানদের মৃতদেহ নিয়ে উল্লাস করছে । আমরা কিছুই করতে পারছি না চোখের পানি ফেলা ছাড়া । কিন্তু দেখেন আমরা সবাই সুস্থ সবল পুরুষ। আমাদের শক্তি আছে সাহস আছে, নাই শুধু এতটুকু সাহায্য । নাই এতটুকু নিরাপদ মাটি যেখানে দাড়িয়ে নিজেকে প্রশিক্ষিত করব । তারপর গড়ব সুকঠিন এক প্রতিরোধ যা আমাদের হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেবে , ফিরিয়ে দেবে বোনের মুখে হাসি ও শিশুদের নির্ভয় কলতান।

দোকানে বসা সবার চোখ পানি ভরে উঠল । আমি নিজের চোখের পানি লুকাতে মাথা নিচু করে ফেললাম।

সারারাত বিছানায় ছটফট করলাম কখন সকাল হবে । পরদিন দুপুর সাড়ে তিনটায় আমরা টেকনাফের বোটে উঠলাম। বিদায় জানলাম আমার অসহায় মুসলমান ভাইদের । যারা রাতের আধারে গুমরে গুমরে কাদে আর দিনে আলোয় মলিন মুখে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে কখন এই পরাধীনতার সূর্যটা ডুববে । উদয় হবে স্বাধিনতার সুর্য যার আলোয় মুসলমানদের মুখে ফুটবে হাসি । মসজিদে মসজিদে উঠবে আযানের ধ্বনি ফজর , যোহর , আছর মাগরীব ও এশার ।

সেইদিন আর কতদুরে বলতে পারেন কেউ ?

সমাপ্ত ।

বৃদ্ধ পিতা ও তার সন্তান ।


শান্ত সুনিবির এক গ্রাম । সেই গ্রামে ছিল এক বৃদ্ধ আর বৃদ্ধা । তাদের একমাত্র ছেলে, সে থাকে শহরে। সেখানে এক বড় কোম্পানিতে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা । কোম্পানিতে তার যথেষ্ট সুনাম আছে । কোম্পানীর মালিক তার কর্ম দক্ষতা ও আদব-কায়দায় তার উপর খুবই সন্তষ্ট । সে মালিককে এতটাই সম্মান করে যে, মালিক মাঝে মাঝে ভাবে, ছেলেটি হয়ত কোন সম্ভ্রান্ত ঘরের সন্তান । তার পিতা-মাতা নিশ্চয় খুবই ভদ্র এবং শিক্ষিত তাই এমন সন্তান হয়েছে।

সেই সন্তান মালিকের প্রতি যতটা শ্রদ্ধাশীল নিজের পিতা-মাতার প্রতি ততটাই উদাসীন । মাস শেষে বাড়িতে বৃদ্ধ পিতা-মাতার জন্য মাসিক খরচ পাঠিয়ে তার দ্বায়িত্ব শেষ করে দেয় । এরপর আর কোন দ্বায়িত্ব পালন করার প্রয়োজন অনুভব করে না । এদিকে তার পিতা-মাতার সে একমাত্র সন্তান হওয়ায়, তার প্রতি তারা অত্যধিক স্নেহশীল । তাই তাকে দেখার জন্য সব সময় উদগ্রীব হয়ে থাকে । কিন্তু ছেলেটি তার পিতা-মাতাকে দেখার জন্য গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার এতটুকু সময় হয় না ।

এমতবস্থায় একদিন তার বাবা তার কাছে চিঠি লিখলেন।

স্নেহের পুত্র

জানিনা কেমন আছ ? তুমিত বড়ই ব্যাস্ত । এই বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে প্রতি মাসে একবার এসে দেখারও সময় তোমার হয়না । তুমি আমাদের এক মাত্র সন্তান। তোমাকে দেখলে আমাদের হৃদয়টা প্রশান্তি লাভ করে । আমাদের আর কোন সন্তান নাই । তোমার সন্তানদেরও কাছে পাই না । তাদের কচি কোমল কন্ঠে দাদা-দাদি ডাক শোনার জন্য, আমাদের বুভুক্ষ এই খালি বুকটা সারাদিন হাহাকার করে । নিজেদের সকল পুঁজি আর ভালবাসা স্নেহের পরশ দিয়ে তোমায় চিরকাল আগলে রেখে বড় করেছি । আজ আমাদের এই অসহায় আর একাকিত্বের সময় তুমি তোমার ব্যাস্ততার অজুহাত দেখিয়ে আমাদেরকে মাসেত দুরে থাক বছরে একবারও দেখতে আস না। মাস শেষে শুধু টাকা কটা পাঠিয়ে মনে কর নিজের দায়িত্ব শেষ করেছ ।

বাবা তুমি যদি আসতে না পার, তাহলে আর টাকা পাঠিও না । আমরা তোমার টাকার জন্য আল্লাহ কাছে খুজে তোমাকে দুনিয়াতে আনিনি । তোমাকে দুনিয়াতে এনেছি তোমার সান্নিধ্য ও ভালবাসা , তোমার সন্তানদের পরশ ও তাদের মুখে দাদা-দাদি ডাক শুনব বলে। তোমাকে আদর স্নেহ করে বড় করেছি বৃদ্ধ বয়সে তোমার সেবা পাব বলে । পৃথিবীর বুকে কারও কাছে যেন ছোট না হও, তাই নিজেদের শ্রম আর আর পরিশ্রম দিয়ে তোমাকে শিক্ষিত করেছি । আজ সব কিছু পেয়ে নিজে স্বয়ংসম্পূর্ন হয়ে আমাদের প্রতি তোমার দ্বায়িত্ব ভুলে গেছ। এই জন্যই কি তোমাকে কোলেপিঠে করে মানুষ করেছি ?

ইতি

তোমার হতভাগ্য পিতা।

পিতার চিঠি পড়ে ছেলেটি খুবই বিরক্ত হয়ে গেল। ভাবতে লাগল হায় আমার পিত-মাতা বুঝে না এখানে আমাকে টিকে থাকতে কতই না পরিশ্রম করতে হয়। সকালে ঘুম থেকে কি যে দৌড় শুরু হয়, তা গ্রামে থাকা পিতা-মাতা কি করে বুঝবে।

ছেলে তারপরও সিদ্ধান্ত নিল আগামি কালই সে গ্রামে যাবে । তারপর বুড়া আর বুড়িকে বুঝিয়ে দিবে কেন সে আসতে পারেনা ।

পরের দিন ছেলেটি তার গ্রামের বাড়িতে পৌঁছল । বিশাল বাড়ি সুনসান নীরবতা । মনে হয় এই বাড়িতে কেউ থাকে না । সে ভিতরে প্রবেশ করল । কাউকে দেখতে পেল না । তখন সে পাকের ঘরের দিকে গেল । দেখল তার স্নেহময়ী মা মাথা নিচু করে তরকারি কুটছে। ছেলের পায়ের আওয়াজ শুনে, তিনি মাথা তুলে তাকালেন ।

ছেলেটি দেখতে পেল, বহুদিন পর আসা একমাত্র ছেলেকে দেখতে পেয়ে তার মায়ের ধুসর বিষণ্ন চোখ দুটি এক অপার্থিব উজ্জলতায় ভরে গেল । দুর্বল শরীরে তাড়াতাড়ি উঠতে যেয়ে মায়ের শরীরটা যেন একটু দুলে উঠল । ছেলে তাড়াতাড়ি এগিয়ে মাকে জড়িয়ে ধরে মায়ের পতন ঠেকাল। মা ও তার প্রিয় সন্তানের বুকে আশ্রয় পেয়ে পরম নির্ভরতায় আকড়ে থাকল । ছেলের মনে হল মায়ের শরীর যেন একটু কাঁপছে। বুঝতে পারল তাকে কাছে পাওয়ার উত্তেজনায় কাঁপছে। অনেক দিন তাকে পেয়ে মা এমন ভাবে ধরে রেখেছে যেন আর কোথাও যেতে না পারে।

ছেলে অস্ফুষ্ট কন্ঠে মাকে বললঃ মা বাবা কোথায় ?

বহুদিন পর ছেলের মুখে মা ডাক শুনে মায়ের দুই চোখ ভিজে উঠল। শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মুছতে মুছতে মা বললঃ বাড়ির পিছনের উঠানে বসে আছে ।

ছেলে আস্তে করে মাকে ছেড়ে পিছনের উঠানে গেল । ছেলের পিছে পিছে মা ও এগিয়ে গিয়ে দরজার চৌকাঠে দাড়িয়ে থাকল।

ছেলে উঠানে এসে দেখতে পেল বাবা একটা লম্বা টুলের উপর বসে রোদ পোহাছ্ছে। ছেলে সালাম দিয়ে আস্তে করে বাবার পাশে বসল । বাবা সালামের উত্তর দিল, তবে পাশে বসা ছেলের দিকে ফিরে তাকালেন না । ছেলে জিগ্গাসা করলঃ কেমন আছেন?

ঃ ভাল ।

তারপর আর কোন কথা না বলে চুপচাপ কিছুক্ষন বসে থাকল । কিছুক্ষন পর বাবা ছেলেকে একটা কাক দেখিয়ে জিগ্গাসা করলঃ বাবা ওটা কি ?

ঃ কাক।

তারপর কিছুক্ষন চুপচাপ থেকে আবার বললঃ ওটা কি ?

ছেলে আবার বললঃ কাক ।

কিছুক্ষণ পরে বাবা আবার বললঃ ওটা কি ?

ছেলে এবার কিছুটা রেগে গেল, তারপরও নিজেকে সামলে নিয়ে বললঃ কাক ।

আবার কিছুক্ষন চুপ থেকে বাবা বললঃ ওটা কি ?

এবার ছেলে নিজের রাগ আর সামলে রাখতে পারল না বললঃ আপনাকে বার বার বলছি ওটা কাক ওটা কাক তারপরও আপনি বারবার জিগ্গাসা করছেন ব্যাপারটা কি ?

বাবা এবার ঘুরে ছেলের রাগান্বিত চেহারার দিকে তাকালেন তারপর স্ত্রীকে বললেনঃ আমার টেবিলের উপর থেকে ডায়রীটা নিয়ে আসত।

মা টেবিলের উপর থেকে ডায়রীটা এনে স্বামির হাতে দিলেন । বাবা ডায়রিটা হাতে নিয়ে বেশ ভিতরের পাতা উল্টিয়ে ছেলেটির হাতে দিলেন ।

ঃ পড়ে দেখ ।

ছেলেটি অবাক হয়ে ডায়রীটি হাতে নিয়ে পড়তে লাগল।

আজ আমাদের একমাত্র ছেলের তিন বছর বয়স পার হয়েছে। সে একটু একটু আধো আধো বোলে কথা বলতে পারে । আমি স্কুল থেকে এসে ওকে কোলে নিয়ে বাড়ির পিছনে উঠানে বসেছি। এমন সময় ও একটি কাক দেখতে পেল। সে কাকটাকে দেখিয়ে বললঃ ওতা কি ?

আমি বললামঃ কাক।

আবার বললঃ ওতা কি ?

আমি বললামঃ কাক।

আবার বললঃ ওতা কি ?

আমি বললামঃ কাক।

এভাবে পনের হতে বিশ বার সে আমাকে একই প্রশ্ন করেছে । আমি প্রতি বারই একই উত্তর দিয়েছি।

ছেলেটি ডায়রীটি হাতে নিয়ে পাথরের মত স্তব্দ হয়ে গেল। তার দুই চোখ দিয়ে অনুতাপের নোনা জল ঝরঝর করে পড়তে লাগল। মাথা নিচু করে সেই চোখের জল লুকাতে গিয়ে বাবার বুকে আশ্রয় নিল ।

ওদিকে দরজার চৌকাঠে দাড়ানো তার স্নেহময়ী মা আচলের বাধ দিয়েও চোখের জল আটকাতে পারছে না।

পাঠক- পাঠিকারা আসুন আমাদের যাদের মা বাবা আছে তারা উনাদের সঠিক মূল্যায়ন করি । উনাদের শ্রদ্ধা করি ও সেবা করি । আর যাদের নাই তারা আল্লাহর কাছে উনাদের জন্য মাগফেরাত কামনা করি। রাব্বীর হামহুমা কামা রাব্বা ইয়ানী ছগ্বীরা ।

শুক্রবার, ৫ জুলাই, ২০১৩

ফেলে আসা স্রোত । ( স্মৃতিচারন। )

    আমার দাদী যাকে আমার প্রায় আট নয় বছর বয়সে হারিয়েছি । সেই আমার দাদীর কাছেই বড় হয়েছি ছয় বছর বয়স পর্যন্ত । কারন আমার বয়স যখন দশ মাস তখন জন্ম নেয় আমার ছোট ভাই । আমার মায়ের পক্ষে দুই সন্তানকে এক সাথে পালন করা সম্ভব নয় তাই দাদী আমাকে তার সাথে করে বাড়িতে নিয়ে যায়।
এই কারনে আমার শৈশবটা কেটেছিল দাদার বাড়িতে । পদ্মার নদীর থেকে অনেকটা দুরে আমার দাদার বাড়ি পূর্ব নাম বিক্রমপুর বর্তমানে মুন্সিগন্জ । শ্রীনগর থানার পাঠাভোগ গ্রামের সিকদার বাড়ি আমার দাদার বাড়ি ।
গ্রামের বাড়িতে সবাই খুব ভোরে উঠত। ভোরে ঘুম ভাংগলেই দেখতাম দাদি পাটখড়ি দিয়ে ঘেরা ছন দিয়ে ছাওয়া পাকের ঘরের মাটির চুলায় ফু দিয়ে লাকড়িতে আগুন ধরাছ্ছে । আহ ! সেই ভোরে আগুন দেওয়া চুলার ধোয়ার ঘ্রান এখনও যেন পাই । সকালে ঘুম থেকে উঠলেই ছোট ফুপু নয়ত দাদী আমাকে বেতের পেয়ালা ( বেত দিয়ে বানানো পেয়ালা যা তখন পাওয়া যেত । এখন আর নাই ।) করে মুড়ি আর মিঠাই দিত । গরম কাল হলে আখের মিঠাই শীতকাল হলে খেজুরের মিঠাই দিত। জানিনা এতে হয়ত আমার পেটে কৃমির প্রকোপটা বেশি ছিল। তাই প্রায় মধ্যরাতে ঘুমের মাঝে প্রচন্ড পেটের ব্যাথা হত । সেই ব্যাথায় চিৎকার করে কান্না করতাম । তখন দাদী আর ফুপু কতকিছুই না খাওয়াত । পিয়াজের রস খাওয়াত এতে না কমলে সেই গভীর রাতে বাড়ির পিছনের জংগলে অনাদরে বেড়ে উঠা আনারস গাছের কচি পাতার গোড়ার সাদা অংশটা পাটায় বেটে রস বের করত। সেই রস খাওয়ানোর পর আমার পেটের ব্যাথা কমত।
আমার সবচেয়ে বেশি ভয় করত সকালে পায়খানায় যাওয়া । কি এক বিভিষিকাময় এক অবস্থা । ঐ এলাকায় বছরে চার মাস পানি থাকে । পানি থাকা বলতে পাহাড় সমান উচু ভিটাটা ছাড়া ক্ষেত-বিল, ডোবা-পুকুর , নদী রাস্তা-ঘাট সব পানিতে ডুবে থাকে । তখন কোসা নৌকায় করে গ্রামের লোকদের চলাফেরা করতে হয়। সবার বাড়িতেই একটা দুইটা কোসা নৌকা থাকে। পাহাড় সমান উচু ভিটার পায়খানাটা থাকত ভিটা সমান উচুতে বেশ কিছুটা দুরে কোন ডোবার উপর । পায়খানাটা বানানো হত বিরাট লম্বা লম্বা চারটা বাশের খুটি দিয়ে । ভিটা থেকে পায়খানায় যেতে চিকন একটা সাকো বা পুল থাকত। ওটার উপর দিতে খুব সাবধানে যেতে হত । একটু বেশি নড়াচড়া করলেই সাকোটি হেলতে দুলতে থাকত । এই হেলাদুলা যদি থামানো না যেত তাহলে পাপৎ ধরনী তল। আর পড়বি পড়বিত পর সোজা মলমূত্রের ভাগারে । আর কিছু বলতে চাইনা । তখন সেখানে বড় বড় গুই সাপ দেখা যেত । এখন নাই ।
শীতের কাল ছিল আরেক মজার দিন । দাদীর হাতের নানা রকম পিঠার এক মেলা। ভাপা পিঠা , পাটিসাপটা পিঠা , চিতই পিঠা আরো কত রকমের পিঠা ছিল। রাতের ভাত খাওয়ার দাদী ও আশেপাশের আত্মিয় মহিলারা মিলে শুরু করতেন পিঠা বানানো । এরপর পিঠা বানিয়ে পিঠার সিক্কায় তুলে রাখতেন সেই খোলামেলা পাকের ঘরে । শীতের হিমেল ঠাণ্ডায় সেই হাঁড়ির ভিতর পিঠাগুলি ঠাণ্ডা হ্যে যেত।
আবার সুবহে সাদেকের সময় কুয়াশা ভেজা আঁধারে দাদী একা ঘুম থেকে উঠতেন । এরপর শুনা যেত মাটির হাঁড়ি পাতিলের ঠুকাঠুকি । সেই ঠুকাঠুকিতে গভীর ঘুমের মধুর স্বপ্ন ভেংগে যেত । আবার পাশ ফিরে লেপটাকে আরও জোরে আকড়ে ধরে আবার গভীর ঘুমে হারিয়ে যেতাম । পরে ঘুম থেকে উঠে খেতাম দাদীর হাতের খেজুর রসের পিঠা ।সেই খেজুর রস এখন আর পাইনা , পাইনা সেই স্বাদ।
আমাদের বাড়ির দক্ষিন দিকে ছিল একটা ছাড়া ভিটা ( সেই ভিটায় বহু বছর কেউ বাস করে না ।) আমি প্রায় সেই ভিটায় প্রায় একা চলে যেতাম । ভিটাটিতে নানা ধরনের গাছ ছিল । আম, জাম, হিজল, কড়ই, বড়ই, বাশ গাছ , গাব আরও কত গাছ । গাব খাওয়ার লোভে ওখানে আমার বেশি যাওয়া হত। পাকা পাকা গাব মাটি থেকে কুড়িয়ে খেতাম। কি সেই স্বাদ । পৃথিবীর এমন কোনও ভাষা নাই যা দিয়ে সেই স্বাদ বোঝাব। আমি কখনও একা বা আমার চাচাত ভাই বোনেরা সহ সেই সব গাছের ছায়ায় বসে পুতুল খেলা , দাড়িয়া বান্ধা , ডাংগুলি , কুতকুত খেলা , দড়ি খেলা আরো কত খেলা যে খেলতাম । সারা দিন আমরা ছোটরা ওখানে থাকতাম।
আমার বয়স যখন পাচ পাড় হয়ে ছয়ে পড়লাম তখন আমাকে স্কুলে ভর্তি করা হল । এখনও মনে আছে প্রথম দিন যখন স্কুলে যাই আমার ছোট ফুপু আমার মাথায় বেশি করে নারকেল তেল দিয়ে সুন্দর করে মাথা আচড়ে দিল । তারপর একটা আদর্শ লিপি বই, বাল্য শিক্ষা ধারাপাত ও একটা স্লেট আর তার পেন্সীল দিয়ে দিল। আমি এরপর আমার চেয়ে কয়েক বছরের বড় দুই বোন ও সমবয়সী ভাইয়ের ( এরা আমার বড় চাচার ছেলে মেয়ে । ) সাথে স্কুলে গেলাম । স্কুলটা ছিল এক কামরার একটা ঘর । সেখানে ক্লাস ওয়ান থেকে ফাইভ পর্যন্ত সবাই একই সাথে বসতাম । সেই স্কুলে আমাদের সবেধন নীলমণি মাত্র একজন শিক্ষক ছিলেন । উনার নাম ছিল বিমল স্যার । আজও বেচে আছেন আমার সেই শ্রদ্ধেয় শিক্ষক । তবে এখন আর পড়ান না ।
প্রতি বছর পহেলা বৈশাখে আমাদের গ্রামে মেলা হত । এখনও হয় । তবে ছোটাকালের মত আর যাওয়া হয় না। শৈশবে তখন মেলায় যেতাম দাদার কাধে করে । আমার দাদা আমকে বেশির ভাগ সময় কাধে নিয়েই চলাফেরা করতেন । কেননা আমি দাদার কাধের দুই পাশে দুই পা দিয়ে চড়তে বেশি পছণ্দ করতাম। দাদা আমাকে কাধে করে মেলায় নিয়ে যেতেন । মেলায় যেয়ে প্রথমেই আমি একটা মাটির নৌকা নিতাম তারপর অন্য কিছু । সেই মাটির নৌকা বাড়িতে এনে তার সামনের দিকে একটা সুতা বেধে সারাদিন মাটির উপরে হেচড়ে হেচড়ে চালাতাম । নৌকাটি না ভাংগা পর্যন্ত চলত আমার নৌকা নিয়ে খেলা।
আমার দাদা ছিল মাছের রাঈশের মানুষ। আমাদের সারা গ্রামে উনার মত মাছ কেউ ধরতে পারত না। যেখান শত বার জাল ফেলেও কেউ মাছ পেত না সেখানে আমার দাদা একবারেই জাল ভরে মাছ তুলত। যা আজও আমাদের গ্রামের কিংবদন্তির হয়ে আছে। আমি প্রায় সময় দাদার সাথে মাছ ধরতে যেতাম । আহঃ কি সেই দিন !! আর কখনও পাব না ফিরে । আকাশে মেঘের ঘনঘটা । কালো শ্লেটের মত আকাশে ক্ষনে ক্ষনে বিদ্যুৎ চমকাছ্ছে । দাদা সামনে কাধে জাল নিয়ে একটু গুজো হয়ে খালি পায়ে হাটছে । আমি পিছনে ভয়ংকর আকাশের দিকে তাকিয়ে দুরুদুরু বুকে ভিরু ভিরু পায়ে ধান ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে হাটছি । কতবার যে আইলের থেকে ক্ষেতের ভিতর পা পিছলে পড়ে যাছ্ছে তার কোন হিসেব নাই। দাদা হাটতে হাটতে একসময় কোন খাল বা নদীর পাড়ে এসে দাড়াতেন । তারপর নদীর বুকে চোখ বুলিয়ে তার সবল হাতে ছুড়ে মারতেন জাল। জালটাও বিশাল হা করা মুখ নিয়ে নদীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ত। এরপর জালটা নদীর তলে বসে গেলে দাদা এবার আস্তে আস্তে টানতে থাকতেন । জাল গুটিয়ে মাটিতে তোলার সাথে সাথে আমি বসে যেতাম জাল থাকে মাছ ছাড়ানোর কাজে । এভাবে একবার মাছ ছাড়াতে যেতে বাইন ( বাইন মাছ নয়। ) মাছের মত এক মাছ আমার কচি একটা আংগুলে দিল কামড়। মাছের কামড়ে আমার আংগুল কেটে রক্ত বের হয়ে গেল । তখন আমার সেকি কান্না । বৃষ্টির পানি আর আমার চোখের পানি এক হয়ে সেদিন নদীর জলে মিশে গিয়েছিল। জানিনা এতে নদীর পানি একটু বেড়ে ছিল কিনা ? তবে আমার দাদার ফোকলা দাতের হাসিতে আমি লজ্জা পেয়েছিলাম।শৈশব প্রেম সে এক মধুর অভিগ্গতা । যদিও জানি না সেটা প্রেম ছিল না অন্য কিছু ছিল। কেন না আমরা দুজন প্রায় বাড়ির পিছনে জংগলে খেলতাম । বাড়ির কেউ যখন আমাদের কোথাও খুজে পেত না তখন বুঝত আমরা দুই দুষ্টু মনি ঐ জংগলে আছি। ওখান থেকে আমাদের ডেকে নিত দুপুরের ভাত বা অন্য কোন নাস্তা খাওয়ার জন্য। ঝড়ের দিনে যখন আম গাছ থেকে আম ঝরে পড়ত তখন আমার সেই বাল্য সাথী আমাকে ডাকত আম কুড়ানোর জন্য । বড় বড় ফোটার বৃষ্টি নয়ত শীল (ছোট ছোট বরফের টুকরা ) পড়ছে আমরা আম গাছের তলে আম কুড়াছ্ছি । পাকা আম কাচা পাকা আম কুড়ইয়ে কোচড়ে ভরছি । কে কত বেশি নিতে পারে তাই নিয়ে কত কাড়াকাড়ি কত মারামারি । একটা আম দেখলে সবাই দৌড়ে নিতে যেয়ে গায়ে গায়ে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতাম। গাছ পাড়া আমের চেয়ে কুড়িয়ে পাওয়া আমের স্বাদ যেন অ ——নে—–ক বেশি।