অনুবাদ করুন ।

মঙ্গলবার, ১০ ডিসেম্বর, ২০১৩

ঘুরে এলাম মায়ানমার ।

 বৃহস্পতি বার রাতের এগারটায় হঠাৎ আমার মেজ কুটুম ( শালা ) ফোন করল

ঃ দুলাভাই বার্মা যাবেন নাকি ?

উল্লেখ্য আমার মেজ কুটুম গত তিন বছর যাবৎ টেকনাফে দোকান নিয়ে মায়ানমারের সাথে ব্যাবসা করছে ।

ওর এই প্রস্তাবে আমিও উৎফুল্ল হয়ে গেলাম । তারপরও নিজের ব্যাবসার কথা চিন্তা করে আবার মিইয়ে গেলাম । তারপরও বললামঃ কখন যাবে ?

ঃ কালকে শুক্রবার ।

ঃঠিক আছে । কালকে গেলে তোমাকে ফোন করব।

ঃ কালকে গেলে সকালে আমাদের বাড়িতে চলে আসবেন । এখান থেকে জুম্মার নামায পড়ে রওয়ানা দেব।

ঃআছ্ছা ।

শুক্রবার দিন সাধের ঘুম জলান্জলী দিয়ে সকাল আট টা বাজে উঠে গেলাম । গোসল আর নাস্তা করতে করতে প্রায় নয়টা বেজে গেল । তাড়াতাড়ি বাসা থেকে বের হলাম। বাসার সামনে থেকে রিক্সা নিয়ে নিউমার্কেটের মোড়ে গেলাম । সেখান থেকে টেম্পোতে করে নতুন ব্রীজ পৌছলাম।



নতুন ব্রিজ।

এখান থেকে যেতে হবে সাতকানিয়া । । ভাল কোন গাড়ি পাছ্ছিনা । ভাল গাড়ি বলতে এস আলম , সৌদিয়া , শাহ আমিন । এরা অন্য দিন সাতকানিয়া আমিরাবাদের লোকদের জামাই আদর করে গাড়িতে তুলে । শুক্রবার হলে তারা আমাদের ( সাতকানিয়া ও আমিরাবাদি ) চিনেই না । কক্সবাজার যেতে যে সাতকানিয়া, আমিরাবাদ বলে কোন জায়গা আছে ওরা যেন ভুলেই যায় । নতুন ব্রীজ থেকে সাতকানিয়ার স্বাভাবিক ভাড়া ৬০ টাকা । আজ শুক্রবার, তাই ভাড়া ১০০ টাকা । এই হল আমাদের সোনার বাংলাদেশ ।কোন আইন নাই, কানুন নাই । যার যেমন ইছ্ছা ভাড়া বাড়িয়ে ফেলে । প্রশাসন আছে কিন্তু তাদের এই সব দেখার সময় নাই । তারা সরকারের গদি সামলাবে না এই সব দেখবে ?

প্রশাসন এখন ক্ষমতাশীন রাজনীতিকদের সেবক । সাধারন জনগনের সেবা করার সময় কোথায় ?

যাই হোক একটা লোকাল গাড়িতে উঠালাম । এই গাড়িই অন্যান্য দিন লোকাল ভাড়ায় চলে । আজ জাতে উঠেছে, তাই স্পেশাল সার্ভিস হয়েছে। কনট্রাক্টর আর হেলপারের যে ভাব, মনে হয় গাড়ি নয় ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের প্লেনের ক্রু ।

গাড়িতে উঠলাম । বসে আছি । গাড়ি এখনও ছাড়েনি আসন পূর্ন করে যাত্রী সব নেওয়া হলে, তারপর বাস ছাড়বে । প্রায় পৌনে এগারটার দিকে বাস ছাড়ল ।

এই সময় মেজ কুটুম ফোন করলঃ কোথায় ?

ঃবাসে ।

ঃ ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি নিয়েছেন?

ঃ নাত ! কেন?

ঃ মায়ানমার যেতে হলে মায়ানমারের পাসপোর্ট বানাতে হবে । তখন ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি লাগবে ।

আমি কিছুক্ষন চিন্তা করে বললাম অসুবিধা নাই বন্দোবস্ত হবে যাবে ।

এরপর যোগাযোগ বিছ্ছিন্ন করে দিলাম ।

তারপর বাসায় ফোন করলাম । আমার বেগমকে বললামঃ দেখোতো বাসায় আমার ভোটার আইডি কার্ডটা আছে কিনা ?

সে খুজে পেলানা ।

বুঝলাম বাসায় নাই । ছোট ভাইকে ফোন করলাম । বললামঃ আমার দোকানের দেরাজের ভিতর ভোটার আইডি কার্ডটা আছে । তুই ওটা নিয়ে আমার ই-মেইলে পাঠিয়ে দে।

জুম্মার আযানের আধা ঘন্টা আগে কেরানী হাট নামলাম ।



কেরানি হাট।

ওখান হতে সিএনজি করে আনুফকিরের দোকানে নামলাম । ততক্ষনে আযানের সময় হয়ে গেছে । এস্তেনজা ( টয়লেট ) ও অজু করে আনুফকীরের দোকানের মসজিদে জুম্মার নামায আদায় করলাম।

ওখান থেকে প্রায় এক কিলোমিটার ভিতরে আমায় জান্নাতবাসি মায়ের কবর। আহ ! কি মায়া মাখা ছায়া ঢাকা সেই কবর। চারদিকে সুপারী গাছের ঘেরা । সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো শান্ত নিবির পরিবেশে শুয়ে আছে আমার জান্নাতবাসি মা । সেখানে যেয়ে জিয়ারত করলাম ।

জান্নাতবাসি মায়ের কবর জিয়ারত করে সোজা শ্বশুর বাড়ি চলে এলাম। সেখানে দুপুরের খাওয়া-দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিলাম। শ্বশুর বাড়ির খাওয়াত ! এমন ভূড়ি ভোজনের পর বিশ্রাম না নিয়ে কি পারা যায় ?

তারপর আমি আর মেজ কুটুম বের হয়ে সোজা আমিরাবাদ। ওখানে আছরের নামায পড়ে , টেকনাফের উদ্দেশে বাসে উঠার জন্য বাস কাউন্টারে গেলাম । বাস কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম ভীষন ভীড় । শুক্রবার দিন বিকালে সবাই ফেরার জন্য হুড়োহুড়ি করছে । কারন শনিবার সকাল থেকে কর্মক্ষেত্র যেতে হবে । আমার মেজ কুটুম বহু কষ্টে সৌদিয়া বাসের দুটি টিকিট যোগাড় করল । আমরা মাগরীবের আগে আগে গাড়িতে উঠলাম ।

গাড়ি চলতে লাগল টেকনাফ লিংক রোডের উদ্দেশে । গাড়ি যখন চকোরিয়ার কাছাকাছি তখন মাগরীবের নামাযের সময় গেল। ভাবলাম নামযের জন্য গাড়ী দাড়াবে তাই একটু আপেক্ষা করলাম । নাহ ! গাড়ি থামল না । তখন সিটের উপর নামায পড়ার সিদ্ধান্ত নিলাম । মেজ কুটুমকে বললাম তুমি উঠে দাড়াও আমি নামাযটা পড়ে নিই । ও উঠে দাড়ালে আমি নামায পড়ে নিলাম । আমার নামায পড়া দেখে ড্রাইভার মেজ কুটুমকে বললঃ আপনারা নামায পড়বেন বললেন না কেন ? বললেইত আমি গাড়ি থামাতাম।

ও কোন উত্তর দিল না ।

আমি নামায পড়ার পর মেজ কুটুম পড়ল।

ভাবতে অবাক লাগে !! বাংলাদেশ ৮০% মুসলমানের দেশ। সেই দেশে একটি বাসের চল্লিশ জন হতে পাচচল্লিশ জন মানুষের মধ্যে আমরা মাত্র দুইজন মানুষ নামায পড়লাম । তাহলে আর সবাই কি বিধর্মী...........। এই যদি হয় অবস্থা ! তবে এই দেশে নাস্তিকদের আস্ফালন বাড়বে না কেন ?

এশার নামাযের আগে আমরা কক্সবাজার হতে অনেকটা আগে লিংক রোডে নামলাম । ওখানে নেমে একটা হোটেলে ঢুকে মুখ-হাত ধুয়ে নিলাম । তারপর ভূনা গরুর গোশত আর ছেকা ( কম তেলে ভাজা ) পরাটা দিয়ে নাস্তা করলাম । খাওয়া দাওয়ার পর টেকনাফগামী গাড়িতে উঠলাম । প্রায় রাত সাড়ে দশটার দিকে টেকনাফ পৌছলাম .......।



ঘুরে এলাম মায়ানমার। ( এক )

তারপর দিন সকালে যখন ঘুম ভাংগল মেজ কুটুম বললঃ তাড়াতাড়ি উঠুন । আজকে শনিবার তাই তাড়াতাড়ি এই রুম খালি করতে হবে। আমি অবাক হয়ে বললামঃ কেন ?

ঃ এই রুমের ভাড়া আমরা দুইজনে দেই । একজন আমি, আরেকজন ইন্সুরেন্স কোম্পানির লোক। আড়াই হাজার টাকা ভাড়ার মধ্যে ওই লোক দেয় দেড় হাজার আমি দেই এক হাজার । আমরা ব্যাবহার করি সারা সপ্তাহ আর ওই লোক করে শুধু শনিবার সকাল দশটা থেকে দুপুর একটা ।

এই কথা শুনে কি দেরি করা যায় !! তাড়াতাড়ি উঠে মুখ হাত ধুয়ে বের হয়ে গেলাম । হাটতে হাটতে বেশ কিছুটা এগিয়ে ভাল একটা হোটেল দেখে ঢুকে পড়লাম ।

সেখানে পরাটা আর মুগ ডাল দিয়ে নাস্তা করলাম। নাস্তা শেষে এক কাপ চা পান করে হোটেল থেকে বের হলাম। মেজ কুটুমকে বললামঃ এবার কাজ কি ?

ঃ এবার আপনার দুই কপি ফটো তুলতা হবে এক কপি পাসপোর্ট সাইজ আরেক কপি স্টাম্প সাইজ , আর আপনার ভোটার আইডি কার্ডের ফটোকপি করতে হবে ।

ঃ তাহলে এক কাজ কর। আমাকে কোন সাইবার ক্যাফেতে নিয়ে যাও ।

তারপর আমরা দুইজনে টেকনাফে সাইবার ক্যাফে খুজতে বের হলাম । অনেকক্ষন খুজেও কোন সাইবার ক্যাফে পেলাম না। হাটতে হাটতে কাচা বাজারের কাছে চলে এলাম । কাচা বাজারে টাটকা মাছ আর সবজী দেখে সাইবার ক্যাফের কথা ভুলে গেলাম ।



মেজ কুটুমকে বললামঃ এখানে মাছের দাম বোধহয় কম তাই না ?

ও দুইচোখ কপালে তুলে বললঃ কম দা-ম !!!! কি যে বলেন না, বরং শহরের চেয়ে দাম বেশি ।

আমি অবাক হয়ে বললামঃ বল কি !! কেন এখানে নদী সমুদ্র দুইটাইত কাছে তারপরও এত দাম ?



ঃ এখানকার মানুষের ক্রয় ক্ষমতা এত বেশি যে কোন জিনিসের দাম যতই বেশি হোক ওরা কিনতে ভয় পায় না ।

ঃ এত টাকা পায় কই ?

ঃ কেন ডব্লিউ আর লবন।

ঃ ডব্লিউ এটা আবার কি ?



ইয়াবা ।

ঃ ইয়াবা । এখানে উচ্চ হতে সাধারন জনগন প্রায় সবাই কম বেশি ডব্লিউ ব্যাবসার সাথে জড়িত । এছাড়া আরও অন্যান্য ব্যাবসাত আছেই। কানাঘুষায় শুনি টেকনাফের বর্তমান এম পি বদি এই ডব্লিউ ব্যাবসার প্রধান পৃষ্ঠপোষক। সে এই ব্যাবসা করার জন্য প্রশাসন, আওয়ামীলীগ , বি এন পি , জামাতের প্রায় সব নেতাকে সাথে নিয়েছে । এই ব্যাপারটা এখানে ওপেন সিক্রেট ।

এখানকার প্রত্যেক যুবক আলীশান ভাবে জীবন যাপন করে । তাই এখানে দামি দামি মোটর সাইকেলের এত ছড়াছড়ি । এখানে সবাই এক । তাই রাজনৈতিক প্রতিহিংসা নাই বললেই চলে । এই জন্য টেকনাফে ইয়াবার কোন চালান ধরা খায়না বললেই চলে । ইয়াবার চালান যা ধরা খায় সব টেকনাফের বাইরে । সত্য মিথ্যা আল্লাহই ভাল জানেন। এই টেকনাফে এমপি বদির কথাই শেষ কথা । একবার এক বি ডি আর তাকে না চিনে তার গাড়ি থামিয়ে ছিল বলে । এম পি বদি গাড়ি থেকে নেমে সেই বি, ডি, আরকে সজোরে এক থাপ্পর মেরেছিল । এই কথা বদির সমর্থকরা গর্ব করে সবাইকে বলে।

ঃ আমি শুনে " থ " !!!

ভাবতে লাগলাম যেই দেশের জননেতা সেই দেশের যুব সম্প্রদায় অর্থাৎ এই রাষ্ট্রের ভবিষ্যত নেতৃত্ব দান কারী প্রজন্মকে ধ্বংস করার নেশার দ্রব্য আমদানী করে , সেই দেশের ভবিষ্যত যে কতটুকু অন্ধকার তা ভেবে শিউরে উঠলাম। আর এদেরকেই আমরা ভোট দেই । অবশ্য এরা আমাদের ভোটের থোরাই কেয়ার করে । নিজের ক্যাডার বাহিনী দিয়ে নিজেরাই ভোট আদায় করে নেয়।

মনে হল এই দেশে জন্মই আমার আজন্মের পাপ।

আমাকে স্তব্দ হয়ে দাড়িয়ে থাকতে দেখে আমার মেজ কুটুম বললঃ কি হল দাড়িয়ে গেলেন যে ?

আমি ওর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে হাটতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর মেজ কুটুম আবার বললঃ বেশ কিছুদিন আগে টেকনাফে প্রধান মন্ত্রি এসেছিল। তখন জনসভায় এমপি বদি জনতাদের উদ্দেশে বলেছিলঃ আপনারা কে কে আগামীতে আমাকে এমপি হিসেবে দেখতে চান তারা হাত তুলুন ।

অবাক কান্ড হাজার হাজার মানুষের মধ্যে মাত্র শখানেক হাত উঠেছিল ।

এই ব্যাপারে পরে এমপি বদিকে জিগ্গাসা করা হলে সে বলেছিলঃ আমার কথা সব জনতা বুঝতে পারেনি ।

যাই হোক আবার সাইবার ক্যাফে খুজতে লাগলাম। পেলাম না । তখন আমি বললামঃ চল আগে ছবিটা তুলে ফেলি, তারপর ঐ ফটোর দোকানে জিগ্গাসা করলে হয়ত জানতে পারব কোথায় সাইবার ক্যাফে আছে ?

হাটতে হাটতে একটা ফটোর দোকানে ঢুকলাম। বললাম ফটো তুলব । আপনারা কি ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটো তুলেন ?

ওরা বললঃ হ্যাঁ ।

আমি বসে গেলাম । একটা ছেলে ডিজিটাল ক্যামেরায় ফটো তুলল ।

ফটো তুলার পর একটা ল্যাপটপে ঢুকাল । দোকানের মালিক কম বয়সি একটা ছেলে। দেখলাম সে ছবিটা এডিট করে একটা পাসপোর্ট সাইজ একটা স্টাম্প সাইজ করে দুইকপি করে চার কপি প্রিন্ট আউট করল। এই সময় আমি দেখলাম ওর ল্যাপটপে ইন্টারনেট মডেম লাগানো।

ঃ আপনার কি ইন্টারনেট কানেকশান আছে ?

সে হ্যাঁ বলতেই বললামঃ আমার ই-মেইল থেকে আমার ভোটার আইডি কার্ডটা প্রিন্ট আউট করে দেন।

ছেলেটা জিমেইলে যেয়ে আমাকে দিয়ে মেইলটা খুলে নিয়ে ডাউনলোড করে নিল। ওর ল্যাপটপে ডাউনলোড হওয়ার পর প্রিন্ট আউট করল। তারপর একটা ফটো কপি করলাম। কাজ শেষ হলে জিগ্গাসা করলামঃ কত দেব ?

ঃ আশি টাকা দেন ।

টাকা দিয়ে দোকান থেকে বের হলাম ।

এইবার মেজ কুটুম বললঃ আপনার কাছে যত টাকা আছে সব, আর মোবাইল দুইটা দিন ।

ঃআমি অবাক হয়ে বললামঃ কি ব্যাপার ছিনতাই কারী হয়ে গেলে নাকি ?

ও হাসতে হাসতে বললঃ না ওগুলো নিয়ে মায়ানমার যাওয়া যাবে না, তাই দোকানের ছেলেকে আসতে বলেছি এগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য । আপনার দরকারি নাম্বারগুলো কাগজে লিখে নিন । মায়ানমার থেকে তাহলে ফোনে কথা বলতে পারবেন।

তারপর সে আমাকে নিয়ে একটা দোকানে গেল । দোকানটা বোধহয় পূর্ব পরিচিত । ওখানে একজন থেকে একটা কাগজ আর কলম নিয়ে, আমাকে দিল বললঃ নাম্বারগুলো লিখে নিন ।

আমি দাড়িয়ে কাউন্টারের উপর কাগজ রেখে নাম্বারগুলো লিখতে লাগলাম। এইসময় ময়লা বোরকা পরা একজন মহিলা প্রবেশ করল । বয়স ত্রিশের কম বেশি হবে । সে দোকানের ছেলেটার কাছে দাড়িয়ে এক ধরনের উচ্চারনে চিটাগাং এর ভাষায় কথা বলছিল । পরে জেনেছি ওটা রোহিংগা ভাষা । সে ছেলেটি কে বললঃ কেমন আছ ?

ঃ ভালআছি ।

ঃ আমার টাকাটা দাও ।

ঃ কিসের টাকা ?

ঃ কেন মালের বাকি একশ আশি টাকা ।

ঃ না দেব না ।

ঃ কেন দিবা না । আমি গরিব মানুষ এই একশ আশি টাকা দিলে বাজার করব । তারপর রান্না করে খাব।

আমি মেজকুটুমকে আস্তে করে জিগ্গাসা করলাম মেয়েটি কে ?

ঃ রোহিংগা । বার্মা থেকে দুই চার হাজার টাকার মাল বৈধ পথে টেকনাফে এনে বিক্রি করে ।

ছেলেটি মহিলাটির কথার প্রতিউত্তরে বললঃ এই টাকার জন্য তুমি মরে যাবা ?

ঃ তুমি জান ? আজকে সকালে আধাপেট ভাত খেয়ে বের হয়েছি । বাচ্চাদেরও পেট ভরে খাওয়াতে পারিনি।

আমি আর শুনতে পারলাম না । মেজ কুটুমকে নিয়ে আস্তে করে দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম । ঐ মেয়েটি যদি ভিক্ষুক হত তাহলে কিছু টাকা দিয়ে নিজেকে হালকা করতাম ।



কিন্তু মহিলাটিত তা নয় , সেত খেটে খাওয়া আত্মনির্ভরশীল একজন নারী। যে নারী জীবন যুদ্ধে মরতে জানে, পরাজয় বরন করতে জানেনা । তাকে শ্রদ্ধা করা যায় তার জীবনার্দশ অনুসরন করা যায় । এমন নারীকে ভিক্ষা দেওয়া যায় না। 


দোকানের ছেলেটা এল। ওর হাতে সব কিছু দিয়ে আমি আর মেজ কুটুম টেকনাফ বাস স্ট্যান্ডের দিকে চলে এলাম। এখানে একটা ট্যাক্সিতে উঠলাম । সিএনজি চলতে শুরু করল। টেকনাফ শহর ছেড়ে সিএনজি চলতে চলতে পিচ ঢালা পথ বেয়ে উচু দিকে উঠতে লাগল ।



এই রাস্তাটা পাহাড় কেটে তৈরি করা হয়েছে। সিএনজি উঠতে উঠতে যখন উপরের সমতলে চলে এল তখন প্রকৃতির রুপের ছটায় আমার ভ্রমন ক্লান্ত মনটা মুগ্ধ হয়ে গেল। অন্তরের অন্তস্থল থেকে বের হয়ে এলঃ আলহামদুল্লিলাহ !! হে আল্লাহ কত সুন্দর আমার জন্মভূমি ! তুমি আমায় এই দেশে জন্ম দিয়েছ তাই আমি ধন্য।



ওখান থেকে দেখা যায়, পাহাড় হতে যেন সবুজের গালিচা গড়িয়ে গড়িয়ে নেমে গেছে নাফ নদীর রুপালি তটে । নদীর রুপালি তটও গড়িয়ে গড়িয়ে পড়েছে নদীর নীলাভ ঢেউয়ের বুকে । সেখানে বাতাস আর ঢেউয়ের কত অজানা কানাকানি । নদীর পাড়ের কাছাকাছি ছোট ছোট নৌকা নিয়ে জেলেরা মাছ ধরছে।



নাফের ঐ পাড়ে মায়ানমার সীমান্তে গাঢ় সবুজ পাহাড় যা দেখতে অনেকটা কালচে রং এর মনে হয় । বিশাল উচু উচু সব পাহাড়। দেখে মনে হয় একজন আরেকজনের কাধেঁ হাত রেখে দাড়িয়ে টেকনাফের পাহাড় গুলোর সাথে আড্ডা মারছে । মাথায় তাদের ছাই রংয়ের মেঘের টুপি । হয়ত সেই টুপি থেকে ঝরঝর বৃষ্টি হছ্ছে । এতদুর থেকে দেখা যাছ্ছে না।



সোজা বন্দরে চলে এলাম । সিএনজি থেকে বন্দরের দিকে প্রবেশ করতেই গেটের ভিতরে একটা ওয়াচ ঘর । সেখানে পাচজন বর্ডার গার্ড বসে আছে । তাদের মধ্যে তিনজন পুরুষ, দুইজন তরুনী । পুরুষরা আগতদের সাথে কথা বলছে তথ্য লিখছে । তরুনীদ্বয় বর্ডার গার্ডের পোষাক পড়ে শোভা বর্ধন করছে অর্থাৎ বসে আছে। মেজ কুটুম ওর পাসপোর্ট দিল। বর্ডার গার্ডরা পাসপোর্ট থেকে তথ্য লিপিবদ্ধ করে নিল। মেজ কুটুম এবার আমার ভোটার আইডি কার্ড ও ছবিগুলো দিল । ওরা বললঃ নতুন?

ঃহ্যাঁ ।

আমার দিকে তাকাল তারপর তথ্যগুলো লিখে আমাকে জিগ্গাসা করলঃ বাড়ি কোথায় ?

বললাম।

ঃ নাম কি ?

ঃ বললাম।

এরপর আর কিছু জিগ্গাসা করল না । আমার জন্য নতুন পাসপোর্টের বই দিয়ে দিল। বইটা এখনও পাসপোর্ট হয়নি। এবার আরও সত্তর গজের মত ভিতরে গেলাম। হাটতে হাটতে মেজকুটুম বললঃ আপনার ভাগ্য ভাল মাঝে মাঝে এখানে এমন কতগুলো বসে , অসম্ভব কর্কশ ভাষী ।

আমি মুখে কিছু বললাম না । মনে মনে বললাম সীমান্ত প্রহরীদের ব্যাপারে হযরত ইব্রাহীম আলাইহী ওয়াসাল্লামও মন্তব্য করেছেন । কারণ বিবি সায়রাকে নিয়ে তিনি যখন মিশর সীমান্ত পার হছ্ছিলেন তখন এই সীমান্ত প্রহরীরা উনাকে বিপদে ফেলেছিল ।

এখানে একটা বিল্ডিং দুই তলা । প্রবেশ করলাম । ভিতরে তিনজন লোক বসা । মেজ কুটুম একজনকে কাগজ পত্র সব দিল । যাকে দিল দেখলাম সে মেজকুটুমের সাথে খুব আন্তরিক ভাবে কথা বলছে। এমনকি নাম ধরেও ডাকছে । বুঝতে পারলাম এখানে মেজ কুটুমের সাথে সবার সম্পর্কটা ভাল । লোকটি বলল ঃ ইনি তোমার কে হন ?

ঃ আমার বড় বোনের স্বামি।

শুনে লোকটা উৎফুল্ল হয়ে বললঃ দুলাভাই !!

আমাকে জিগ্গাসা করলঃ কি দুলাভাই বেড়াতে যাবেন ?

আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বললাম।

যাই হোক এখানে দ্রুত সব কিছু হছ্ছিল । পাসপোর্ট বাবদ এক হাজার টাকা জমা দিতে হল। এই পাসপোর্টের মেয়াদ এক বৎসর । এখান থেকে মায়ানমারের ভিসা দিবে সাত দিনের । এই ভিসা নিয়ে মায়ানমার গেলে মায়ানমার সরকার ভিসা দিবে মাত্র তিন দিনের ।

এরপর আমার আর মেজ কুটুমের ছবি কম্পিউটারে তুলে নিল।

মেজ কুটুম বললঃ আগেত ছবি নিতেন না ।

ঃ একটু ঝামেলা হয়েছে তাই নতুন নিয়ম করেছে।

যাই হোক আমার অপূর্ব সুন্দর মায়াবী (??! ) চেহারা খানা ওদের কম্পিউটারের মেমোরিতে রেখে আমরা ঘাটের উদ্দেশে রওয়ানা হলাম । ঘাটে পৌছার আগেই বিল্ডিং এর পিছনের গেটের সামনে এক লোক টিকিট হাতে দাড়িয়ে আছে মেজকুটুম ওর কাছ থেকে দুইটা টিকিট নিল।

মেজ কুটুম বললঃ মায়ানমার যেতে একবারই টিকিট কাটতে হয় । এটাই আসা-যাওয়ার টিকেট। একটু তাড়াতাড়ি হাটেন । বোট বোধহয় ছেড়ে দিছ্ছে ।

আমরা দ্রুত পদক্ষেপে প্রায় দুইশ গজ পরে বোটের সামনে এসে দাড়ালাম। এখানে আরেকজন লোক আমাদের টিকেটের একটু করা অংশ ছিড়ে নিয়ে নিল।

আমি বোট দেখে মুগ্ধ !! আমি আগে ও দেশ ছেড়ে বিদেশ গিয়েছি। তখন গিয়েছি ওমান এয়ার লাইন্সে এসেছি গালফ এয়ারে । আহ !! কি আরামের ভ্রমন ! কিন্ত এখানে !!! বিদেশ যাওয়ার একি বাহন !! যাব না পালাব ভাবছি ।



এই সময় মেজ কুটুম বললঃ কি হল উঠুন । বোট ছেড়ে দিছ্ছেত ।

ওর কথার তাগাদায় আমি চমকে কখন যে নাফ ওয়াটার ওয়েজে উঠে গেছি নিজেই জানিনা। উঠে কাঠের পাটাতনে বসলাম । আমি একটু মোটাসোটা মানুষ । ওজন ৭৬ কেজি । তাই বসতে একটু কষ্ট হছ্ছিল । মেজ কুটুম আমার আশেপাশে জায়গা পেলনা তাই একটু দুরে বসল।

এই বোট দিয়ে মানুষ টানে আবার মালও টানে । বোটের মধ্যেখানে খোলের মত আছে । মাল টানার সময় সেখানে মাল নেয় । মানুষ পারাপাড়ের সময় নারী ও শিশুদের ওখানে বসানো হয়। আমি যেখানে বসেছি তার সামনে বোটের ইন্জিন । ইন্জিন হতে প্রায় চার-পাচঁ হাত দুরে , আমার পিছনে বোটের সারেং দাড়ায় । অর্থাৎ যার হাতে বোটের হাল থাকে । বোটটাকে মুলত সেই চালায় । ইন্জিনের কাছে ছোট্ট একটা ছেলে বসে থাকে । বয়স এগার হতে তের বছর হবে । ছেলেটির কাজ হল ইন্জিন স্টার্ট দেওয়া , গিয়ার বদলানো, বোটের গতি বাড়ানো কমানো আর বোটের খোলের ভিতর পানি জমলে সেই পানি তুলে নিয়ে নদী তে ফেলা ।

বোট ছিল নারী-পুরুষ আর দুইটি শিশুতে ভর্তি । বোট ছেড়ে দিল । আমারও বারটা বাজা শুরু হল। ইন্জিনের এমন ভটভটি আওয়াজ আমার কানের পর্দা যায় যায় অবস্থা। বোটটা এমন ভাবে মানুষে ভর্তি যে নড়াচড়ারও জায়গা নাই । কি আর করা কোন প্রকারে সহ্য করে থাকতে হল। 
 

আকাশটা মেঘলা তাই রোদের তাপ নাই। নদীর বাতাস একটু গরম। মাঝে মাঝে হালকা গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হছ্ছে। বোট দ্রুত গতিতে মাঝ নদীতে প্রবেশ করল । টেকনাফ অনেকটা পিছনে চলে গেছে ।

আমি আকাশের দিকে তাকালাম । সামনে একটা ঘন কালো মেঘের আস্তর দেখে মনে মনে কিছুটা শঙ্কিত হয়ে, মেজ কুটুমকে জিগ্গাসা করলাম ঃ ছাতি এনেছ ?

ও আকাশের দিকে তাকিয়ে বললঃ না আনিনি । আপনি চিন্তা করবেন না বৃষ্টি পড়লে ছাতির ব্যাবস্থা হয়ে যাবে।

ওর কথায় আশ্বস্থ হয়ে চুপ হয়ে গেলাম। বোট এগিয়ে চলছে। আমি কতক্ষন নদীর ঢেউ গুনি কতক্ষন খোলের ভিতর এক বোরকা পড়া এক সুন্দরী মেয়ের কান্ড কারখানা দেখি। সুন্দরী মেয়েদের বয়স আন্দাজ করা কঠিন তাই ঐ কঠিন অংকে গেলাম না । পাঠক-পাঠিকারা যার যার মত বয়সটা কস্ট করে ধরে নিবেন । যদিও আপনাদের কষ্ট দেওয়ার জন্য দুঃখিত।

মেয়েটি তার সামনে বসা চার বছরের একটি বাচ্চা মেয়ের সাথে খুটসুটি করছিল । সুন্দরীর আর বাচ্চা মেয়েটির খুনসুটি বোটের সবাই মিলে উপভোগ করছি আর মায়ানমারের দিকে এগিয়ে চলছি । যদিও বোটের মুখ এখন পর্যন্ত সমুদ্রের দিকে, তাই বাম পাশে মায়ানমার এখনও আনেকটা দুরে ।

প্রায় পৌনে এক ঘন্টা পর আমারা বৃষ্টির কবলে পরলাম । হঠাৎ ভারী বর্ষনে ছাতি নিতে নিতে আমরা বোটের সবাই অর্ধেক ভিজে গেছি। মেজ কুটুম তার ব্যাবসায়িক বন্ধুর ব্যাগ হতে একটা সুন্দর লেডিস ছাতি বের করে দিল। ছাতি ওয়ালা বেচারা মনে হয় ছাতি খানা স্যাম্পল হিসেবে মায়ানমার নিয়ে যাছ্ছিল । ছাতি পয়ে মোটামোটি বৃষ্টির হাত থেকে আমি সহ কয়েকজন রক্ষা পেলেও মেজ কুটুমসহ বেশির ভাগ যাত্রীই ভিজে গেল। ছয়-সাত মিনিট পরই বৃষ্টি চলে গেল । এরপরই এমন রোদ উঠল যে ছাতি আবার খুলতে হল।

প্রায় দেড়ঘন্টা পর হঠাৎ বোট তার মুখ ঘুরিয়ে বামে মোড় নিল । এবার আমাদের বোটটি বড় নাফ নদী ছেড়ে ছোট একটা খালে প্রবেশ করল । খালে প্রবেশ করা মাত্র আমরা মায়ানমার সীমান্তে ঢুকে গেলাম । খালের দুই পাশে তাকালাম। বোটের ডান দিকে অর্থাৎ সুমদ্রের দিকে একটু খানি এলাকা । ঐ এলাকা পুরাটাই প্রায় পনের ফুট উচু কাটা তার দিয়ে ঘেরা । বেশ কিছুদিন আগে মায়ানমারে যে সাম্প্রদায়ীক দাংগা হয়েছিল, তখন মুসলমান রোহিংগা যারা আকিয়াব ( মায়ানমারের সীমান্ত প্রদেশ । সীমান্ত থেকে প্রায় তিন মাইল দুরে । ) থেকে নৌকা করে পালিয়ে এসেছিল তারা যেন আবার মায়ানমারে ঢুকতে না পারে তাই এই ব্যাবস্থা । দেখে আমার চোখ ছলছল করে উঠল। না জানি কত অসহায় মুসলমান ভাই বোনেরা সারারাত ঐ কাটা তার ধরে দাড়িয়েছিল আর দুই চোখের নোনা জল ফেলে কতই না কাকুতি মিনতি করেছিল মগাদের কাছে একটু আশ্রয় আর খাবার পানি পাওয়ার আশায়। বাংলাদেশেও তারা আশ্রয় চেয়েছিল । আমাদের পাষান হৃদয় তাদের আশ্রয় দিতে পারিনি । আমরা দিতে না পারলেও দয়ালু নাফ নদী তার বুকে অনেককেই আশ্রয় দিয়েছে। জানি না কাল কেয়ামতের মাঠে কি জবাব দেব মহাপরাক্রান্ত আল্লাহ তালার কাছে।

বাম দিকে তাকালাম দেখলাম বিশাল প্রান্তরে শুধু একটা সেমিপাকা ঘর তার পাশে বৌদ্ধদের উপসনালয়।



সোনালী রংয়ের ছটায় জ্বলজ্বল করছে । দেখে মনে হয় এইমাত্র রং করেছে।

আস্তে আস্তে বোট মায়ানমার বন্দরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল । খালের মুখ হত মায়ানমার প্রায় তিন-চারশ গজ দুরে হবে। কিছুক্ষনের মধ্যে আমাদের বোট মায়ানমার বন্দরে ভিড়ল । আমারা সবাই নামলাম। বন্দরে সব মগা জাতির লোক । তাদের পরনে বেশির ভাগেরই স্যান্ডো গেন্জি । আমি আস্তে আস্তে উঠতে লাগলাম। এই সময় বন্দরের এক মগা অফিসার ইশারায় আমার মাথা টুপিটা খুলে ফেলতে বলল । প্রথম ধাক্কাটা খেলাম এখানে । এক প্রকার অপমানিত বোধ করে টুপিটা খুলে ফেললাম । যেই দেশে যেই নিয়ম । মানতেত হব । সেই সাথে মনে মনে শপথ করে ফেললাম জীবনে যদি বেচে থাকি এই দেশে আর আসব না।

ওখানে এক মধ্যে বয়স্ক এক অফিসার আছে সে আমাদের দাড়িয়ে থাকতে দেখে বসতে বলল। তার সাথে পানের কৌটা ছিল সেখান থেকে আমাদের পান খাওয়ার জন্য অনুরোধ করল। আমি সবিনয়ে উনার মেহমানদারী প্রত্যাখ্যান করলাম। এখানে সবাই প্রচুর পান খায় । একটার পর একটা পান মুখে দেয় । পানের সাথে প্রচুর পরিমানে চুন খায় । মেজ কুটুমকে জিগ্গাসা করলামঃ ওরা যে এত চুন খায় ওদের জিহ্বা পুড়ে যায় না ?

ঃ না ওদের জিহ্বা পুরে না। ওরা চুনের মধ্যে কি যেন মিশ্রিত করে চুনটা এক ধরনের মিষ্টি হয়ে যায়।

বন্দর অফিসাররা আমাদের পাসপোর্ট ভিসা চেক করল। তারপর জিগ্গাসা করল কোন হোটেলে উঠব?

মেজ কুটুম হোটেলের নাম বলল। আমি অবাক হয়ে মেজ কুটুমের দিকে তাকাতেই সে বললঃ এখানে কোন মেহমান বা বিদেশি এখানকার কোন স্থানিয়দের বাসায় রাত্রি যাপন করতে পারেনা। অতিথিদের রাতে হোটেলে থাকতে হয় । আর এখানকার ভিসা তিনদিনের । তিনদিনের ভিতর আপনি যদি ফেরৎ না যান তাহলে এখানকার নাসাকা বাহিনী আপনাকে হোটেল থেকে খুজে এনে বোটে তুলে দিবে ।

এখানকার কাজ শেষ । আমরা এগিয়ে গেলাম সেখানে লম্বা একটা কামরায় প্রবেশ করলাম । এখানে আমাদের ফটো তোলা হবে। আমরা প্রবেশ করতেই দেখি সেই সুন্দরী মেয়েটির ভাই উত্তেজিত ভাবে কথা বলছে। আর সেই মেয়েটি মেয়েদের চেক করার ছোট্ট একটি রুমের দরজায় দাড়িয়ে হাসছে।

মায়ানমারের এক মগা মহিলা অফিসার । তার পরনে সাঃা ফুল হাতা জামা আর কালচে সবুজ রংয়ের থামি ( লুংগীর মত ।)। মগা মহিলাটি মেয়েদের দেহ চেক করে। সে দোভাষীকে উত্তেজিত ভাবে কি যেন বলছে। দোভাষি যখন অনুবাদ করে মেয়েটির ভাইকে বোঝাছ্ছিল তখন বুঝতে পারলাম ঘটনাটা কি ?

দেহ তল্লাশী করার জন্য যখন মায়ানমারের মহিলা সুন্দরী মেয়েটিকে রুমে নিয়ে যাছ্ছিল, তখন তার ভাই বাধা দিয়েছিল। ভাইটির বাধা দেওয়াটা কিছু বাড়াবাড়ি ধরনের হওয়াতে, মায়ানমারের মহিলাটি ক্ষেপে গিয়েছে। মায়ানমারের মহিলা দোভাষীকে বললঃ যে দেশের যে নিয়ম তা পর্যটকদের মানতে হবে। তানা হলে সেই দেশে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না ।

দোভাষী কথাটা অনুবাদ করে ছেলেটিকে বলল। ছেলেটির বড় বোনের স্বামি ওদের সাথে ছিল । সে ছেলেটিকে ধমক দিয়ে মায়ানমারের মহিলার কাছে ক্ষমা চাইল । তারপর সব কিছু স্বাভাবিক হলে এল । আমি মনে মনে ভাবলাম এইসব মূর্খদের কে বলেছে এখানে আসতে ।

আমারা ওখান থেকে বের হওয়ার পর মেজ কুটুম বললঃ মাথায় টুপিটা দিয়ে দেন । আর হোটেলে যাওয়ার জন্য রিক্সা নেব না হেটে যাবেন ?

আমি বললামঃ এখানে রিক্সা কোথায় ?

মেজকুটুম হাসতে হাসতে বললঃ এই আপনার পাশেই দাড়িয়ে আছে ।

আমার দুই ঠোট ফাক হয়ে মুখে মাছি ঢোকার রাস্তা হয়ে গেল।

আমাদের দেশের বাই সাইকেলের পিছনের চাক্কার পাশে একটা গদির ফ্রেম করে তার সাথে আরেকটা চাক্কা লাগিয়ে এই রিক্সা বানানো হয়েছে । এই রিক্সায় দুইজন প্যাসেন্জার বসে । তবে বসাটাও অদ্ভুত একই সিটে দুই দিকে মুখ করে পিঠে পিঠ লাগিয়ে বসতে হয়। একজনের মুখ থাকে সাইকেলের সামনের দিকে আরেকজনের মুখ থাকে সাইকেলের পিছন দিকে।

আমি রিক্সা দেখে বললামঃ হোটেল কি বেশি দুরে নাকি ?

ঃ না , এইত কাছেই মোড়টা ঘুরলেই পরে হোটেল।

আমরা হাটতে হাটতে হোটেলের দিকে চলতে লাগলাম।



চারদিকে দেখছি গাছগাছালীতে ভরপুর । প্রশস্ত রাস্তা । চারদিক পরিষ্কার পরিছ্ছন্ন । তেমন মানুষ জন নাই । মায়ানমারের সীমান্ত শহর । নাম মোংডু । কত সুন্দর পরিকল্পিত ভাবে তৈরী না জানি রাজধানী কত সুন্দর ।

আমরা বাংগালীরা এই বাংলাদশে চার হাজার বছর ধরে আছি। আমরা বলতে গেলে প্রাচীন জাতিদের মধ্যে একটি । কিণ্তু আমরা এই চারহাজার বছরেও অন্যান্য জাতিদের মত পরিকল্পিত ভাবে নাগরীক কাঠামো গড়ে তুলতে পারলাম না । পারলাম না নিজেদের পরিস্কার পরিছ্ছন্ন জাতি হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরতে ।

কিছুক্ষন হাটতেই হোটলে পৌছে গেলাম । খুব সুন্দর সাজানো গোছানো পরিবেশ । নাম কাহন্নাহ । হোটেলের ম্যানেজারকে জিগ্গাসা করেছিলাম কাহন্নাহ অর্থ কি ? উনি বললেনঃ নদীর কিনারা ।

দোতালায় দুই বিছানার একটি কামরা নিলাম। সেখানে ব্যাগ রেখে । মুখ হাত ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে আবার বের হয়ে গেলাম। সুন্দর রাস্তা এখানকার মানুষদের মুল পোষাক লুংগী আর সার্ট । পোষাকটা অদ্ভুত ভাবে পড়ে। লুংগির ভিতর শার্টটা ইন করে পড়ে। এখানে যে বাহনটা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় । আমাদের দেশের ইয়ামাহা এট্টি ৮০ সি সি মটর সাইকেলের মত মটর সাইকেল । প্রচুর দেখা যায়। এখানে দামও কম । বাংলাদেশী টাকায় বিশ/ পচিশ হাজার টাকা।

আমদের আবাসিক হোটেলে কোন খাওয়া দাওয়া ব্যাবস্থা নাই । দুপুরের খাওয়ার জন্য বের হলাম। এখানে দুই রকমের হোটেল আছে। এক রকম রোহিংগাদের আরেক রকম মগাদের । উল্লেখ্য এখানে কোন বর্মি জাতি নাই সব মগা জাতি । এই কিছুদিন আগে যে দাংগা হয়েছিল তার আগে নাকি মগাদের কোন হোটল ও স্বর্ণের দোকান ছিল না । দাংগার পর ওরা নিজস্ব হোটেল ও স্বর্নের ব্যাবসা শুরু করে । মগাদের প্রত্যেক হোটেলে বিশাল বিশাল এল সিডি টিভি আছে আর মেয়েরাই হোটেল চালায়। রোহিংগাদের হোটেলে কোন টিভি নাই আর পুরুষরা হোটেল চালায়।

তবে খাওয়া দাওয়ার দিক থেকে রোহিংগারা সেরা। এমনকি আমি বলব আমাদের দেশের ভাল ভাল হোটেলে ও এত ভাল স্বাদের এত উন্নত মানের খাদ্য পাওয়া যায় না । সব টাটকা এবং ভেজাল ছাড়া । গরু বলে মহীষের গোশত বেচে না । দেশী মুরগী বলে ফার্ম বেচে না। তবে দামটাও বেশি । বাংলাদেশের এক টাকা মায়ানমারের দশ টাকার সমান। সেই হিসেবে আমরা দুপুরের খাওয়া খেয়েছি ওদের টাকায় চার হাজার টাকা আমাদের দেশের চারশ টাকা। খাওয়া খুব ভালই হল। এখন নামায পড়তে হবে ।

মেজকুটুম বললঃ মসজিদ বাজারের দিকে । চলেন মসজিদে নামায পড়ে আমার বন্ধুর দোকনে আপনাকে বসিয়ে আমি একটু বাজার ঘুরে আসব।

আমরা হাটতে হাটতে মসজিদের সামনে আসলাম । মসজিদটা অনেক পুরানো । জরাজির্ণ অবস্থা । দেখলাম গেটে বিশাল তালা লাগানো।

মেজকুটুম বললঃ চলেন বন্ধুর দোকানে যাই ওখানে পিছনের গেট আছে, ওটা দিয়ে মসজিদে ঢুকে নামায পড়ব।

আমরা ওর রোহিংগা বন্ধুর দোকানে এলাম।



রোহিংগা বন্ধুটি আমায় চিনত , তাই আমাকে দেখে উৎফুল্ল হয়ে উঠল। আমার নাম ধরে ভাই ডেকে ক্যাশ থেকে উঠে এল ।

রোহিংগা চিটাইংগা ভাষায় বললঃ কেমন আছেন ?

ঃ ভাল ।

ঃ বাড়িতে সবাই কেমন আছে ?

ঃ ভাল।

আমি কথা বেশি না বলে তাড়াতাড়ি বললামঃ ভাই কি নামায পড়ব আপনাদের মসজিদের মূল ফটকেত তালা দেওয়া । পিছনে কোন দিক দিয়ে ঢোকা যায় বলে।

বন্ধুটি মুখখানা মলিন করে বললঃ নাসাকা এসে এইটাও বন্ধ করে দিয়েছে।

ঃ বলেন কি ? তাহলে নামায ......।

ঃ একটু বসেন দোকানের পিছনে চাচাত ভাইয়ের বাড়ি আছে ওখানে ব্যাবস্থা করছি। আগে ভাত খান। বাসা থেকে নিয়ে এসেছি।

ঃ না ভাই, ভাত খেয়ে এসেছি। আগে নামাজের ব্যাবস্থা করেন।

কিছুক্ষন পড়ে এক লোক এক বদনা পানি এনে দিল । অজু করলাম । তারপর একটা ঘরে নিয়ে গেল।



উচু পাটাতনের বাড়ি । সেখানে সামনের কামরায় জায়নামাজ বিছানো ছিল। দুই রাকাত যোহরের কছর নামায পড়লাম । কারন আমি মুসাফীর।

নামাজ পড়ার পর বসলাম। সবুজ রংগের মোসাম্বি নিয়ে এল। ওরা বলে লেমু । কেটে প্লেটে করে দিল। সাথে লবন। খেতে খেতে জিগ্গাসা করলামঃ কি ব্যাপার ভাই আপনাদের কি অবস্থা । মসজিদ বন্ধ কেন ?

ঃ ভাই আমাদের সেই দাংগা এখনও শেষ হয়নি। আজ তেইশ বছর কোন মসজিদে আযান দিতে পারি না । গতকাল পর্যন্ত নামাজ পড়েছি মসজিদে । আজ থেকে বন্ধ । জুম্মার নামায পড়তে পারি না । এতদিন যাবৎ পান্জেগানা নামায পড়েছি তবে, জোরে একামত দিয়ে জামাত পড়তে পারিনি। চার-পাচজন মিলে কয়েকবার করে জামাতে নামায আদায় করতাম। সন্ধ্যা ছয়টা বাজে বিদ্যুৎ দেয় রাতের দশটা বাজে আবার বন্ধ করে দেয় । রাতে বিদ্যুৎ যাওয়ার পর নাসাকারা বের হয় । মুসলমানদের ঘরে ঘরে ঢুকে তল্লাশী চালানোর নামে ডাকাতি করে । মেয়েদের গায়ে হাত দেয় । প্রতিবাদ করলে ধরে নিয়ে যায় । তারপর দিন কোর্টে চালান করে দেয় । কোর্টে নেওয়ার সময় মেইন রোড দিয়ে না নিয়ে মগা পাড়া দিয়ে হাটিয়ে হাটিয়ে নিয়ে যায় । মগা পাড়া দিয়ে নিয়ে যাওয়ার সময় মগারা মুসলমানদের অকথ্য ভাষায় গালাগালী করে আর দৈহিক নির্যাতন করে । এতে অনেকে গুরুতর আহত হয়ে যায় । আহত মুসলমানদের দেখে নাসাকা হাসে আর বন্দুকের ডাট দিয়ে মারতে বলে তাড়াতাড়ি চল। বাইরের বিদেশী কেউ বা জাতিসংঘের কেউ সরেজমিনে তদন্ত করতে আসলে। মগারা মুসলমানদের মারে ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় । আর বলে তোরা খবর দিয়েছস তাই ওরা এসেছে। সুকি ওদের ভিতরে ভিতরে সাহস দেয় । উপরে আমাদের জন্য মায়া দরদ দেখায়। আসছে। এই বর্তমান সামরিক সরকার চলে গেলে আমাদের উপর অত্যাচার আরও বাড়বে । প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে মগারা একবার আমাদের উপর চড়াও হয়েছিল । তখন তিনি মায়ানমার সরকারকে বলেছিলেন দুই ঘন্টার ভিতর যদি মুসলমানদের উপর অত্যাচার বন্ধ না হয় তাহলে আমি টেকনাফ দিয়ে আর্মি ঢুকিয়ে দেব। তখন সাথে সাথে মায়ানমার সরকার মগাদের বিরুদ্ধে ব্যাবস্থা নিয়ে ছিল। ( আমি মনে মনে বললাম তখন মায়ানমারের চেয়ে বাংলাদশের সাথে চীনের সম্পর্ক ভাল ছিল।) এরপর অনেকদিন আমরা শান্তিতে ছিলাম । দোকানদারি করতে নানা খবরদারি । মগাদের সাথে বেশি কিছু বলা যায় না। এখানে আমাদের বাংগালী কোন স্কুল নাই । মগাদের স্কুলে বাচ্চাদের পড়াতে হয়। স্কুলে আমাদের বাচ্ছাদের পড়ানো হয় না । মগাদের বাচ্চাদের পড়ানোর সময় আমাদের বাচ্চাদের আলাদা কামরায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা নিজেরা ঘরে যতটুকু পারি বাচ্চাদের পড়াই । যত মাদ্রাসা ছিল সব বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কোরান হাদিসের শিক্ষা এখন বন্ধ । আমরা ঘরে শুধু আরবী অক্ষরটা শিখাই । কোথাও এক জায়গায় বেশি লোক জমায়েত করতে হলে নাসাকা থেকে অর্ডার নিতে হয়। তখন ওরা ওখানে গোয়েন্দা লাগিয়ে দেয়।

খুব কষ্টে আছি ভাই ।

ঃ আপনারা প্রতিরোধ করতে পারেন না ।

ঃ প্রতিরোধ করার জন্য ট্রেনিং নিতে হয় । সেই জন্য অন্য কোন দেশের সাহায্য লাগে । আমাদেরত কেউ সাহায্যও করে না জায়গাও দেয় না। প্রতিনিয়ত আমাদের মুসলমান বোনদের ওরা ধর্ষিত করছে । ধর্ষিতা বোনের দিকে তাকতে পারিনা । তিলে তিলে গড়া আমাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিছ্ছে । বল্লমের আগায় আমাদের শিশু সন্তানদের মৃতদেহ নিয়ে উল্লাস করছে । আমরা কিছুই করতে পারছি না চোখের পানি ফেলা ছাড়া । কিন্তু দেখেন আমরা সবাই সুস্থ সবল পুরুষ। আমাদের শক্তি আছে সাহস আছে, নাই শুধু এতটুকু সাহায্য । নাই এতটুকু নিরাপদ মাটি যেখানে দাড়িয়ে নিজেকে প্রশিক্ষিত করব । তারপর গড়ব সুকঠিন এক প্রতিরোধ যা আমাদের হৃত সম্মান ফিরিয়ে দেবে , ফিরিয়ে দেবে বোনের মুখে হাসি ও শিশুদের নির্ভয় কলতান।

দোকানে বসা সবার চোখ পানি ভরে উঠল । আমি নিজের চোখের পানি লুকাতে মাথা নিচু করে ফেললাম।

সারারাত বিছানায় ছটফট করলাম কখন সকাল হবে । পরদিন দুপুর সাড়ে তিনটায় আমরা টেকনাফের বোটে উঠলাম। বিদায় জানলাম আমার অসহায় মুসলমান ভাইদের । যারা রাতের আধারে গুমরে গুমরে কাদে আর দিনে আলোয় মলিন মুখে চেয়ে থাকে আকাশের দিকে কখন এই পরাধীনতার সূর্যটা ডুববে । উদয় হবে স্বাধিনতার সুর্য যার আলোয় মুসলমানদের মুখে ফুটবে হাসি । মসজিদে মসজিদে উঠবে আযানের ধ্বনি ফজর , যোহর , আছর মাগরীব ও এশার ।

সেইদিন আর কতদুরে বলতে পারেন কেউ ?

সমাপ্ত ।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন