অনুবাদ করুন ।

সোমবার, ৬ মে, ২০১৩

লেংটা ফকির ও তার অদ্ভুত জীবন ধারা ।



আমরা চট্টগ্রাম শহরের পশ্চিম মাদার বাড়ির মোগলটুলী এলাকায় লেংটা ফকিরের মাজারের সামনে থাকতাম । ওখানেই আমার জন্ম । ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত ঐ এলাকায় ছিলাম আমাদের বাসা থেকে প্রায় ষাট সত্তর গজ দুরে ছিল এক পাগলা ফকিরের মাজার । নাম তার ল্যাংটা ফকির । মাজারটা ল্যাংটা ফকিরের মাজার হিসেবে পরিচিত ছিল। ওখানে প্রতিদিন এশার নামাযের পর মিলাদ হত। আমার দাদা প্রতিদিন মসজিদে এশার নামায পড়ে মাজারে যেতেন । মিলাদ পড়ে আমাদের জন্য জীলাপি নিয়ে আসতেন। ওখানে প্রতি বছর ওরশ হত । আমি ঐ ওরশে প্রথম ব্যান্ড পার্টি দেখি । ইউনিফর্ম পড়া নানা ধরনের বাদ্য যন্ত্র নিয়ে মার্চ করা লোকদের দেখে আমি ও আমার ছোটভাই মুগ্ধ হয়ে যেতাম। বিশেষ করে বিশাল ঢোল কাধে নিয়ে চলা লোকটার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকতাম । লোকটা যখন একটা লাঠি নিয়ে ঢোলে বাড়ি দিত তখন ধুম ধুম করে আওয়াজ হত । সেই আওয়াজে আমাদের কচি বুকের খাচায় বসে থাকা হৃদয়টা ধক ধক করে লাফিয়ে উঠত।
তখন লেংটা ফকির জীবিত ছিলেন । ল্যাংটা ফকিরে জীবনটা ছিল অদ্ভুত । হালকা পাতলা ছোটখাট মানুষ । মুখ ভর্তি দাড়ি মোছের জন্গল । প্রায় সময় উলংগ থাকতেন , মাঝে মাঝে শরিরে চটের ছালা জড়ানো থাকতো । মুখে সব সময় থাকতো অশ্রাব গালী-গালাজ । তার ভক্তরা এই গালীকে তাদের প্রতি পীর বাবার দোয়া মনে করে আবেগে আপ্লুত হত । উনার বেশির ভাগ ভক্তই ছিল নারী । এতে আবার কেউ মনে করবেন না উনি নারী লোভী ছিলেন । তিনি আদতে ছিলেন পাগলা ধরনের মানুষ । নারীরা উনার ধারে কাছেও ঘেষতে পারতনা। তিনি যেখানে থাকতেন সেটা ছিল এক রুমের একটা প্রায় আট বাই দশ ফিট আয়তক্ষেত্রের একটা রুম । কামরাটা নানা ধরনে কাগজের বানানো ফুল আর ঝালর দিয়ে সাজানো থাকত । কামরাটা আরও সুন্দর দেখা যাওয়ার জন্য লাগানো ছিল নানা রংয়ের আলোকসজ্জা । ওখানে তিনি একা থাকতেন । তিনি সেখানে সারাদিন বসে থাকতেন । ভক্তরা যে কোন আবেদন নিবেদন করত ঐ রুমের বাইরে থেকে। একটা ভাতের থালা থাকত সামনে , যার বেশির ভাগ ভাতই কামরার ফ্লোরে ছড়ানো ছিটানো থাকত। উনার রুমের সামনে বিশাল একটা ছাতিম গাছ ছিল । এখন নাই উনার মৃত্যুর এক সপ্তাহের ভিতর বিশাল ছাতিম গাছটি উপড়ে পড়ে যায় । সেদিন কোন ঝড় বাদল ছিল না । তবে গাছটা পড়ে যাওয়ার পর দেখা গেল ভিতরটা পিপড়ারা খেয়ে ফাপা করে ফেলেছে । গাছটির চারদিকে সিমেন্ট দিয়ে বাধানো ছিল । সিমেন্ট দিয়ে বাধানো চত্বরে ভক্ত সকল পানি ভর্তি বোতল রাখত । একদিন বিকেলে রেখে গেলে তার পরের দিন বিকেলে নিয়ে যেত । সেই পানি খেলে নাকি রোগ ভাল হয়ে যায় (??? ) । এখনও রাখে তবে আগের সেই জৌলুস নাই।
তার প্রাকৃতিক কর্ম সারার ব্যাপারটা ছিল এক রাজকীয় ব্যাপার। আমরা মাজারের সামনে আমাদের বাসার অনতি দুরে একটা মাঠে খেলতাম । সেই মাঠটার পাশে একটা রাস্তা ছিল । রাস্তার অপর পাশে আরেকটা পুকুরসহ মাঠ ছিল । পুকুরটা ছিল অব্যাবহৃত কচুরিপানয় ভর্তি । ঐ মাঠটায় কেউই তেমন খেলাধুলা করত না । কারন ঐ মাঠটাতে ফকির বাবা প্রকৃতির কাজটা সারতেন । যাইহোক রাজকীয় ব্যাপারটা বলি ।
ল্যাংটা ফকিরের প্রায় পনর-বিশটা পালিত কুকুর ছিল। শুধু পালিত বললে ভুল হবে । তারা ছিল ট্রেনিং প্রাপ্ত। কুকুরগুলো সারাদিন মাজারের ভিতর থাকত । মাজারের বাইরে তেমন একটা বের হত না । কিন্তু ল্যাংটা ফকিরের যখন প্রকৃতির ডাকে সাড়া দেওয়ার সময় হত তখন সব কুকুর একসাথে মাজার থেকে বের হয়ে দৌড়ে মাঠটাতে আসত। ঐ সময় ঐ মাঠে কেউ থাকলে ঘেউ ঘেউ শব্দ তাকে তাড়াত। মাঠে উপস্থিত মানুষ বা গরু ছাগল তখন যদি সরে না যেত তাহলে সব কুকুর মিলে তাকিএ আক্রমন করত। এরকম অবস্থায় একবার একটি দশ-বারো বছরের মেয়ের উরু থেকে কামড়ে গোশত নিয়ে ফেলেছিল । যাই হোক মাঠ খালি হয়ে গেলে কুকুরগুলো আবার মাজারে ফিরে যেত । কিছুক্ষন পর আবার আসত । এবার আসত ঘেউ ঘেউ করতে করতে রাস্তা থেকে যে কোন মানুষকে তাড়িয়ে দিত । এদের পিছে পিছে বেশির ভাগ নারী ও কয়েকজন পুরুষ ভক্ত পরিবেষ্টিত ল্যাংটা ফকির বাবা । তিনি এসে একা মাঠে চলে যেতেন । ভক্তরা রাস্তার উপড় দাড়িয়ে দাড়িয়ে খোলা মাঠে তার মল-মূত্র ত্যাগ করার ঐতিহাসিক দৃশ্য উপভোগ করত। কিছুক্ষণ পড় বাবাজানের কর্ম সম্পাদন হলে তিনি শৌচকার্য ব্যাতিত উঠে মাজারের দিকে চলে যেতেন । তখন কুকুরগুলো সেই মলগুলো .........।
ল্যাংটা ফকিরের একটা ভাল গুন ছিল । তাহল তার মাতৃভক্তি । কোন ভক্তের কোন আবেদনে তিনি যদি সাড়া না দিতেন তাহলে সেই ভক্ত তার মায়ের কাছে যেয়ে যদি বিচার দেয় তখন তার মা এসে এক ধমক দেওয়ার সাথে সাথে ল্যাংটা ফকির সেই ভক্তের আবেদন গ্রহন করতেন । ল্যাংটা ফকিরের বয়স যখন প্রায় চল্লিশ ( চুল দাড়িতে ঢাকা চেহারা দেখে তার বয়স আন্দাজ করা কঠিন ) তার সেই প্রিয় মা মারা যায় । মা মারা যাওয়ার পর সে সারাদিন কান্না করত । খাওয়া দাওয়া করত না জোর করে খাওয়াতে হত। এরপর এক মাসের মধ্য সে নিজেও মারা যায়।
আমরা ঐ এলাকার অধিবাসীরা তার যাবতীয় বুজরুকি পছন্দ না করলেও তার মা ভক্তির কারনে তাকে শ্রদ্ধা করতাম।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন